Friday, March 7, 2014

তুমি মুখ তুলে চাওনি বলেই

তুমি মুখ তুলে চাওনি বলেই —মহাদেব সাহা

তুমি মুখ তুলে চাওনি বলেই দেখো আমি
সব কাজে মনোযোগহীন
সবখানে খাপছাড়া ;
তাই বহুদিন কবিতাও পড়ে আছে অসম্পূর্ণ
একটি পঙক্তি মেলানো হয়নি আর
তুমি ফিরে তাকাওনি বলে,
কতো প্রগাঢ় ইমেজ ঝরে গেছে তোমার
সামান্যতম স্নেহের অভাবে ।

তুমি মুখ তুলে তাকাওনি বলে
কিভাবে যে ক্ষয়ে গেছি অন্তরে-বাহিরে
কিভাবে যে হয়ে গেছি নিঃস্ব, রিক্ত, উদ্দামহীন
শুধু তোমার উপেক্ষা পেয়ে উৎসাহে পরেছে ভাটা,
পরাজয় মেনেছি এভাবে
সব প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে নিজেই
নিয়েছি তুলে লজ্জার মুখোশ ।

ধীরে ধীরে অন্তরালে চলে গেছি সকলের
অজ্ঞাতসারেই,
কাউকে বলিনি কিছু, বুঝতে দেইনি এই গোপন
ব্যর্থতা
শুধু আমি জানি তোমার করুনাধারা ছাড়া
এ জীবনে ফুটবে না মুগ্ধ কিশলয়
মাথায় উঠবে না কোনো জয়ের শিরোপা,
আমার গলায় কেউ পরাবে না গৌরবের মালা ;
তোমার সযত্ন পরিচর্যা ব্যতিরেকে
বলো নিরাময় হয়েছে কখন কার ক্ষত?

তুমি মুখ তুলে তাকাওনি বলে রৌদ্রদগ্ধ হয়ে গেছে
হৃদয়ের ঘন বনাঞ্চল
বর্ষণ-অভাবে সেখানে দিয়েছে দেখা ব্যধি ও মড়ক,
একমাত্র তুমি মুখ তুলে তাকাওনি বলে
এই গ্লানি এই পরাজয় ।
দিনরাত্রি হয়ে গেছে উসকো-খুসকো,
এলোমেলো, সঙ্গতিবিহীন
কিছুই মেলে না আর
সবখানে থেকে যায় একটা না একটা ছেঁড়া তার ;
তাই আমাকে বেড়াতে হয় দেশে দেশে
কান্না ছাড়া আর কোন ঠিকানাও নেই ।

শুধু তুমি মুখ তুলে তাকাওনি বলে রয়ে গেছি সবার
পশ্চাতে
কোথাও পাইনি ঠাই,
সকলের কাছে উপেক্ষিত;
এমনকি যতটা হেঁটেছি পথ,
বিপদের মুখে ভেঙ্গেছি চড়াই
সে কথাও কেউ কখনো বোঝেনি ।

একমাত্র তুমি মুখ তুলে চাওনি বলেই
ভিতরে-বাহিরে এই অপার ব্যর্থতা
শুধু তুমি মুখ তুলে চাওনি বলেই
মরুভূমি গ্রাস করে এখন আমাকে।

ভালোবাসার সংজ্ঞা

ভালোবাসার সংজ্ঞা – রফিক আজাদ

ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,
পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;

ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,
বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি;

ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি
খুব করে ঝুঁকে থাকা;

ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা
ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;

ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালা সামনে
অবিরল কথা বলা;

ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও
মুখোমুখি বসে থাকা।

মাগো, ওরা বলে

মাগো, ওরা বলে---
---আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

‘কুমড়ো ফুলে ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গেছে গাছটা,
আর, আমি ডালের বড়ি
শুকিয়ে রেখেছি—
খোকা তুই কবে আসবি!
কবে ছুটি?’

চিঠিটা তার পকেটে ছিল,
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।

‘মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা, তাই কি হয়?
তাইতো আমার দেরী হচ্ছে।
তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না বাড়ী ফিরবো।
লক্ষ্মী মা রাগ ক’রো না,
মাত্রতো আর কটা দিন।’

‘পাগল ছেলে’ ,
মা পড়ে আর হাসে,
‘তোর ওপরে রাগ করতে পারি!’

নারকেলের চিঁড়ে কোটে,
উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে
এটা সেটা আরো কত কি!
তার খোকা যে বাড়ী ফিরবে!
ক্লান্ত খোকা!

কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝ’রে প’ড়েছে ডাঁটা;
পুঁইলতাটা নেতানো,—
‘খোকা এলি?’

ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে, উঠোনে
যেখানে খোকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।

এখন,
মা’র চোখে চৈত্রের রোদ
পুড়িয়ে দেয় শকুনিদের।
তারপর,
দাওয়ায় ব’সে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খোকা তার
কখন আসে! কখন আসে!

এখন,
মা’র চোখে শিশির ভোর,
স্নেহের রোদে
ভিটে ভরেছে। 

একুশে ফেব্রুয়ারী

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।।
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু
গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী।।
আমার সোনার দেশের
রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।।

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।

সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।

তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।

দেশের সোনা ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি
দিন বদলের ক্রান্তি লগনে তবু তোরা পার পাবি
না না খুনে রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারি
একুশে ফেব্রুয়ারী, একুশে ফেব্রুয়ারী

সেদিন এমনি নীল গগনে বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমু খেয়েছিল হেসে
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা, অলকানন্দা যেন

এমন সময়, এমন সময়, ঝড় এল
ঝড় এল খ্যাপা বুনো
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা
তাদের তরে মায়ের, বোনের, ভাইয়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের বুকে দেশের দাবিকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা আমাদের অন্ন, বস্ত্র, স্বপ্ন নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারী, একুশে ফেব্রুয়ারী"

এক জন্ম

তারাপদ রায়

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।