Monday, September 16, 2013

যাতায়াত

কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।

কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।

নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পখিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেউ বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো।

জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুণ তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।

ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়

আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই
দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম,বলতে এলাম ভালোবাসি।

.

প্রতীক্ষা

কবি: রফিক আজাদ
আবৃত্তি: শিমুল মোস্তফা

এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব'লে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো...
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব'সে আছি-
হয়তো কেউ বলেছিলো, "অপেক্ষা ক'রো
একসঙ্গে বেরুবো।"

এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, "বাড়ি থেকো
ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।"
হয়তো বা ওর মনের মধ্যে ছিলো
চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো;
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি।

যুদ্ধের অনেক আগে
একবার আমার প্রিয়বন্ধু অলোক মিত্র
ঠাট্টা ক'রে বলেছিলো,
"জীবনে তো কিছুই দেখলি না
ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল, তোকে
দিনাজপুরে নিয়ে যাবো
কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,
বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,
পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি,
গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান
পেয়ে যেতেও পারিস,
তৈরী থাকিস- আমি আসবো"
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি;

আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি- শত্রুর জন্যেও
অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে
অপেক্ষায় থেকেছি-

কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো না,
-প্রতীক্ষা করবো।
'প্রতীক্ষা' শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যত্নে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ-দু'টির তেমন কোনো
আলাদা মানে নেই-
কিন্তু আমরা দু'জন জানি
ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,
'অপেক্ষা' একটি দরকারি শব্দ—
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন,
অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
'প্রতীক্ষা'ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্যে প্রতীক্ষা করবো না ?

আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো
দাঁড়িয়ে থাকবো-
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ'রে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে
আমার পায়ে শিকড় গজাবে...

আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না...

যেতে চাস, চলেই যাবি

শান্তি লাহিড়ী

যেতে চাস, চলেই যাবি?
যেতে চাস চলেই যাবি,
কিন্তু কোথায়?
কার কাছে তুই যাবি আমার?
যেতে চাইলে যেতে পারিস,
মস্ত উঠোন এপার ওপার দেখা যায় না,
মাঠ পেরুলেই ফুরিয়ে যাবে চোখের বাঁধন,
হারিয়ে যাবে এবড়ো থেবড়ো ধুলোয় ভরা
এই নিগড়ে বাঁধা হ্রদয়।

যেতে চাস? যা- চলেই যা! 
গেলেই কি আর যেতে পারবি?
পরে থাকবে বিরাট পিছন;
আঁচল ধরে পোষা কুকুর -মেচে।
সেই দিন ঠিক যেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে আলতা মাখলি;
সেই জায়গা টা ভিতর থেকে টেনে ধরলে যেতে পারবি?
হয়তো পারিস! তার উপরে কানের পাশে ঘনো ঘনো
উষ্ণ বাতাস যে মুহূর্তে বয়ে যাবে মনে পড়বে;
মনে পড়বে, মনে পড়বে, মনের দরজায় ডাকাত পরবে। 
তখন কোথায় পালিয়ে বাঁচবি?

সেইতো আবার মানুষ খোঁজা, আবার একটা হ্রদয় খোঁজা।
সব হারানোর ব্যথায়, শোকে গভীর কাওকে জরিয়ে ধরা। 
বেঁচে থাকতে সবি সমান,
আমিও যা তুইও তেমন।

যেতে যেতে সড়ক মিলে-গঞ্জ থেকে বন্দরে যায়
কিন্তু তবু মুঠো খোলে না, সতর্ক চোখ বুজে না। 
কি হারাবি সময়? মানুষ?
অনাগ্রতা হাস্নাহেনা............




অনন্ত প্রেম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার-
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্র"বতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে-
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি-
সকল কালের সকল কবির গীতি।



Sunday, August 11, 2013

যাত্রাভঙ্গ


–নির্মলেন্দু গুণ

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই।

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন কর যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।

তখন আমি একটু ছোঁব
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরণী নায়ে।

নায়ের মাঝে বসবো বটে,
না-এর মাঝে শোবো,
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ
দুঃখ দিয়ে ছোঁব।


Wednesday, May 15, 2013

কিশোর

আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি-পাতার বন্ধনে।
সাগর-জলে পাল তুলে দে’ কেউ বা হবো নিরুদ্দেশ,
কলম্বাসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবো নূতন দেশ।
জাগবে সাড়া বিশ্বময়
এই বাঙালি নিঃস্ব নয়,
জ্ঞান-গরিমা শক্তি সাহস আজও এদের হয়নি শেষ।

কেউ বা হবো সেনানায়ক গড়বো নূতন সৈন্যদল,
সত্য-ন্যায়ের অস্ত্র ধরি, নাই বা থাকুক অন্য বল।
দেশমাতাকে পূজবো গো,
ব্যথীর ব্যথা বুঝবো গো,
ধন্য হবে দেশের মাটি, ধন্য হবে অন্নজল।

ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।
আকাশ-আলোর আমরা সুত,
নূত বাণীর অগ্রদূত,
কতই কি যে করবো মোরা-নাইকো তার অন্ত-রে।

Monday, April 15, 2013

মোদের গরব, মোদের আশা

অতুলপ্রসাদ সেন

মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!
কি যাদু বাংলা গানে!- গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
এমন কোথা আর আছে গো!
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।।
ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
মরি হায়, হায় রে!
আছে কই এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা!
বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন-
আরও কত মধুপ গো!
ঐ ফুলেরি মধুর রসে, বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।।
বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগৎ জিনে-
গরব কোথায় রাখি গো!
তোমার চরণ-তীর্থে আজি, জগৎ করে যাওয়া-আসা
ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে 'মা', 'মা' বলে;
ওই ভাষাতেই বলবো 'হরি', সাঙ্গ হলে কাঁদা-হাসা।।

আমাদের গ্রাম

বন্দে আলী মিঞা

আমাদের ছোটো গাঁয়ে ছোটো ছোটো ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে কেহ নাহি পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
হিংসা ও মারামারি কভু নাহি করি,
পিতা-মাতা গুরুজনে সদা মোরা ডরি।

আমাদের ছোটো গ্রামে মায়ের সমান,
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠভরা ধান আর জলভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ জামগাছ বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পূব দিকে ওঠে
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে।

রাখাল ছেলে

জসীম উদ্দিন


'রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?'

'ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা;
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না!'

রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! আবার কোথায় ধাও,
পূব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।'

'ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া ভাই,
সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।
চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দু-খান পা,
বলছে ডেকে, 'গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা!'
সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই!
সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই!'

'রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! সারাটা দিন খেলা,
এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা!'

'কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙল দিয়ে খেলি
নিড়িয়ে দেই ধানের ক্ষেতের সবুজ রঙের চেলি
সরষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হওয়ার সুখে
মটর বোনে ঘোমটা খুলে চুম দিয়ে যায় মুখে!
ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশি পঊষ-পাগল বুড়ি,
আমরা সেথা চষতে লাঙল মুর্শিদা-গান জুড়ি।
খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা লাঙল-চষা
সারাটা দিন খেলতে জানি, জানিইনেকো বসা।'


নিমন্ত্রণ

জসীম উদ্দিন


তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।

ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া।
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী,
পারের খবর টানাটানি করি-
বিনাসূতি মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তীরের হিয়া।

তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে- নরম ঘাসের পাতে,
চুম্বন রাখি অম্বরখানিরে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচ-লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার পায়ের রঙখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।

তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গ করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া,
তব সনে দেই মিতালি করিয়া,
ঢেলা কুড়াইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।

তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর-লতার সনে,
সীম-আর-সীম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে।
তুমি যদি যাও সে-সব কুড়ায়ে,
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁয়ো চাষিদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে।

তুমি যদি যাও- শামুক কুড়ায়ে, খুব-খুব বড় করে
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে;
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
মনের খুশিতে দিয়ে দেব তাও,
গলায় পরিবে ঝুমঝুম রবে পথেরে মুখর করে,
হাসিব খেলিব গাহিব নাচিব সারাটি গেরাম ভরে।

খুব ভোর করে উঠিতে হইবে, সুয্যি উঠারও আগে,
কারেও কবি না দেখিস পায়ের শব্দে কেহ না জাগে।
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধাল গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগেভাগে,
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।

ভর দুপুরেতে একরাশ কাদা আর একরাশ মাছ,
কাপড়ে জাড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ;
'ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁদর।'
গালি-ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই, আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।

যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
ঘন কালো বন-মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়,
মোর শিশুকাল, লুকায়েছে হায়!
আজিকে সে-সব সরায়ে সরায়ে খুঁজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।



সফদার ডাক্তার

হোসনে আরা


সফদার ডাক্তার মাথাভরা টাক তার
খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে,
চেয়ারেতে রাতদিন বসে গোণে দুই-তিন
পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে।

ইয়া বড় গোঁফ তার, নাই যার জুড়িদার
শুলে তার ভুঁড়ি ঠেকে আকাশে,
নুন দিয়ে খায় পান, সারাক্ষণ গায় গান
বুদ্ধিতে অতি বড় পাকা সে।

রোগী এলে ঘরে তার, খুশিতে সে চারবার
কষে দেয় ডন আর কুস্তি,
তারপর রোগীটারে গোটা দুই চাঁটি মারে
যেন তার সাথে কত দুস্তি।

ম্যালেরিয় হলে কারো নাহি আর নিস্তার
ধরে তারে কেঁচো দেয় গিলিয়ে,
আমাশয় হলে পরে দুই হাতে কান ধরে
পেটটারে ঠিক করে কিলিয়ে।

কলেরার রোগী এলে, দুপুরের রোদে ফেলে
দেয় তারে কুইনিন খাইয়ে,
তারপর দুই টিন পচা জলে তারপিন
ঢেলে তারে দেয় শুধু নাইয়ে।

ডাক্তার সফদার, নাম ডাক খুব তার
নামে গাঁও থরথরি কম্প,
নাম শুনে রোগী সব করে জোর কলরব
পিঠটান দিয়ে দেয় লম্ফ।

একদিন সককালে ঘটল কি জঞ্জাল
ডাক্তার ধরে এসে পুলিশে,
হাত-কড়া দিয়ে হাতে নিয়ে যায় থানাতে
তারিখটা আষাঢ়ের উনিশে।


পাছে লোকে কিছু বলে

কামিনী রায়


করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-
পাছে লোকে কিছু বলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে।
হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
সযতনে শুকায়ে রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা,-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
মহৎ উদ্দেশ্য যবে,
এক সাথে মিলে সবে,
পারি না মিলিতে সেই দলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
বিধাতা দেছেন প্রাণ
থাকি সদা ম্রিয়মাণ;
শক্তি মরে ভীতির কবলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।

পারিব না

কালী প্রসন্ন ঘোষ


পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব এক বার,
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা,
পার কি না পার কর যতন আবার
এক বারে না পারিলে দেখ শত বার।

পারিব না বলে মুখ করিও না ভার,
ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার,
অলস অবোধ যারা
কিছুই পারে না তারা,
তোমায় তো দেখি নাক তাদের আকার
তবে কেন পারিব না বল বার বার?

জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখিতে হলে
আগে তব নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বার বার
পারিব বলিয় সুখে হও আগুয়ান।


মেঘনা পাড়ের ছেলে

আহসান হাবীব

আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে-
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে।
মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি
ইচ্ছে হ'লেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি।
তালে তালে তালের নৌকা
দু'হাতে যাই বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকো আমার ভাসে
মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে-
মাথার ওপর মুচকি হাসে
বিজলি নামের মেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
আমার ঢেউয়ের সঙ্গে গলাগলি ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা
ঝড়ের সঙ্গে লড়াই ক'রে কাটাই সারাবেলা।
দেশ থেকে যাই দেশান্তরে
মনের নৌকা বেয়ে-
আমি মেঘনা নদীর ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।


আযান

কায়কোবাদ


কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!

আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,
কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে
কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।
হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোণিত-ধারে,
কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে-
কত সুধা আছে সেই মধুর আযানে।

নদী ও পাখির গানে তারই প্রতিধ্বনি।
ভ্রমরের গুণ-গানে সেই সুর আসে কানে
কি এক আবেশে মুগ্ধ নিখিল ধরণী।
ভূধরে, সাগরে জলে নির্ঝরণী কলকলে,
আমি যেন শুনি সেই আযানের ধ্বনি।
আহা যবে সেই সুর সুমধু স্বরে,
ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে,
প্রাণ করে আনচান, কি মধুর সে আযান,
তারি প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে।

নীরব নিঝুম ধরা, বিশ্বে যেন সবই মরা,
এতটুকু শব্দ যবে নাহি কোন স্থানে,
মুয়াযযিন উচ্চৈঃস্বরে দাঁড়ায়ে মিনার 'পরে
কি সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আযানে!
জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে।
আহা কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।...

বুঝিবে সে কিসে

কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার

চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে।
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে।
যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।

ষোলা আনাই মিছে

সুকুমার রায়


বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, ''বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?''
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যাল্ফ্যালিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, ''সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।''

খানিক বাদে কহেন বাবু, ''বলতো দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?
বলতো কেন লবণপোরা সাগর ভরা পানি?''
মাঝি সে কয়, ''আরে মশাই অত কি আর জানি?''
বাবু বলেন, ''এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!''

আবার ভেবে কহেন বাবু, '' বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?''
বৃদ্ধ বলে, ''আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?''
বাবু বলেন, ''বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।''

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, '' একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?''
মাঝি শুধায়, ''সাঁতার জানো?''- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ''মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!''

রসাল ও স্বর্ণলতিকা

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;-
শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে।
নিদারুণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে।
মলয় বহিলে, হায়,
নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর- ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী,
মেঘলোকে উঠ শির আকাশ ভেদিয়া!
দূরে রাখি গাভী-দলে,
রাখাল আমার তলে
বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,-
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন!
আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন।
কেহ অন্ন রাঁধি খায়
কেহ পড়ি নিদ্রা যায
এ রাজ চরণে।
মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভূবনে!
তুমি কি তা জান না ললনে?
দেখ মোর ডাল-রাশি,
কত পাখি বাঁধে আসি
বাসা এ আগারে!
ধন্য মোর জনম সংসারে!
কিন্তু তব দুঃখ দেখি নিত্য আমি দুঃখী
নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখী!
নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি
হায়, বায়ুবলে
হারাইল আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে!
ঊর্ধ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নিচ-শির জনে।

কপোতাক্ষ নদ

মাইকেল মধুসূদন দত্ত


সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া- মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা?- যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রুপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সংগীতে।

বীর পুরুষ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।

তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ'ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার 'পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।।

সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন-মনে তাই
ভয় পেয়েছ – ভাবছ, 'এলেম কোথা।'
আমি বলছি, 'ভয় কোরো না মাগো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।'

বঙ্গবাণী

আবদুল হাকিম

কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

মেঘনায় ঢল

হুমায়ুন কবির

শোন মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ ত্বরা করি মাঠে চল,
এল মেঘনায় জোয়ারের বেলা এখনি নামিবে ঢল।
নদীর কিনার ঘন ঘাসে ভরা
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা
করিস না দেরি- আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা মেঘনায় নামে ঢল।

এখনো যে মেয়ে আসে নাই ফিরে- দুপুর যে বয়ে যায়।
ভরা জোয়ারের মেঘনার জল কূলে কূলে উছলায়।
নদীর কিনার জলে একাকার,
যেদিকে তাকাই অথই পাথার,
দেখতো গোহালে গরুগুলি রেখে গিয়েছে কি ও পাড়ায়?
এখনো ফিরিয়া আসে নাই সে কি? দুপুর যে বয়ে যায়।

ভরবেলা গেলো, ভাটা পড়ে আসে, আঁধার জমিছে আসি,
এখনো তবুও এলো না ফিরিয়া আমিনা সর্বনাশী।
দেখ্ দেখ্ দূরে মাঝ-দরিয়ায়,
কাল চুল যেন ঐ দেখা যায়-
কাহার শাড়ির আঁচল-আভাস সহসা উঠিছে ভাসি?
আমিনারে মোর নিল কি টানিয়া মেঘনা সর্বনাশী।

English version of this poem


The Sands of Dee

by
Charles Kingsley

'O MARY, go and call the cattle home,
    And call the cattle home,
    And call the cattle home,
    Across the sands of Dee.'
The western wind was wild and dark with foam,         5
    And all alone went she.

The western tide crept up along the sand,
    And o'er and o'er the sand,
    And round and round the sand,
    As far as eye could see.  10
The rolling mist came down and hid the land:
    And never home came she.

'O is it weed, or fish, or floating hair—
    A tress of golden hair,
    A drownèd maiden's hair,  15
    Above the nets at sea?'
Was never salmon yet that shone so fair
    Among the stakes of Dee.

They row'd her in across the rolling foam,
    The cruel crawling foam,  20
    The cruel hungry foam,
    To her grave beside the sea.
But still the boatmen hear her call the cattle home,
    Across the sands of Dee.

নোটন নোটন পায়রাগুলো

নোটন নোটন পায়রাগুলো
নোটন নোটন পায়রাগুলো
ঝোটন বেঁধেছে
দুই ধারে দুই রুই -কাতলা
ভেসে উঠেছে
কে দেখেছে কে দেখেছে
দাদা দেখেছে দাদা দেখেছে
দাদার হাতে কলম ছিল
ছুড়ে মেরেছে
ওহ ! বড্ড লেগেছে

আয়রে আয় টিয়ে

আয়রে আয় টিয়ে
আয়রে আয় টিয়ে
নায়ে ভর দিয়ে
না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে
তাই না দেখে ভোদর নাচে
ওরে ভোদর ফিরে চা
খুকুর নাচন দেখে যা

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি।   আহা, হাহা, হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।   আহা, হাহা, হা ॥
     কী করি আজ ভেবে না পাই,   পথ হারিয়ে কোন্‌ বনে যাই,
     কোন্‌ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি।   আহা, হাহা, হা ॥
কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে--
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে।
     রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
     মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি।   আহা, হাহা, হা ॥

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি।   আহা, হাহা, হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।   আহা, হাহা, হা ॥

ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি

ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি মোদের বাড়ী এসো
খাট নাই পালং নাই চোখ পেতে বস
বাটা ভরা পান দেব গাল ভরে খেয়ো
বিন্নি ধানের খই দেবো আঁচল পেতে নিও...
খোকার চোখে ঘুম নেই, ঘুম দিয়ে যেও

Saturday, April 13, 2013

আবার যুদ্ধ হলে আমি রাজাকার হব...


তিন যুগ পেরিয়ে গেল, কেউ কথা রাখেনি।
আমার বাবার কথা কেউ মনে রাখেনি।
কেউ খুঁজে দেখেনি আমার হারানো ভাইয়ের লাশ।
কেউ মনে রাখেনি আমার বোনের সর্বনাশ।
তাই আজ আমি বিদ্রোহী...

আবার যুদ্ধ হলে আমি রাজাকার হব,
আবার যুদ্ধ হলে আমি বন্দুক হাতে নেব,
তারপর... ...
একটা একটা করে "বাংলার সোনার ছেলে" গুলি করে মারব।
আবার যুদ্ধ হলে আমি রাজাকার হব,
আবার যুদ্ধ হলে লাল-সবুজ পতাকাটা আমি টুকরো টুকরো করে খাব।
কারণ... ...
গত তিন যুগেও ওরা আমার পিতৃহত্যার কোন প্রতিশোধ নেয়নি।
কোন মূল্য পায়নি আমার বোনের সর্বস্ব বিসর্জন,
ওরা ভুলে গেছে শত শত মায়ের গণধর্ষণ।
তাইতো আজ পতাকাটা পত পত করে ওড়ে গাড়িতে,
কুকুর ছানা রাজাকারগুলো সব শাসকের গদিতে।

আবার যুদ্ধ হলে আমি রাজাকার হব,
তারপর...
যুদ্ধ শেষে গদি হবে আমার, লাল গালিচা আমার, পতাকাও আমার,
আমি হব শাসক রাজাকার।
তারপর?
কুকুর ছানাদের হাত থেকে কেড়ে নেব ঐ লাল-সবুজ "পতাকা"-
আমার বাবার রক্ত, বোনের লজ্জ্বায় হয়েছিলো যা আঁকা।
হায়, সেই পতাকায় আজ ছোপ ছোপ কালো দাগ !
পতাকার পানে চেয়ে আমার ভাইয়ের লাশ আজ নির্বাক !

আবার যুদ্ধ হলে আমি রাজাকার হব...
সাবধান হ হারামজাদার দল,
তোদের আমি চিবিয়ে খাব।
হে ত্রিশ লাখ আত্মা, তোমাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিলাম,
আবার যুদ্ধ হলে আমি রাজাকার হব।

শুধু সেই দিনটির প্রতীক্ষা... কবে হবে সেই যুদ্ধ?
আমি যুদ্ধ চাই, শুধু আর একবার...
কবে হব আমি রাজাকার?

তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা

শামসুর রাহমান

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিত্কার করতে করতে
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব'লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব'লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব'সে আছেন - তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধ'রে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব'লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝড়ে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ'তে চলেছে --
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।

আজিকার শিশু

সুফিয়া কামাল


আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেল।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন ,পরী, দেও, দানা।
পাতালপুরীর অজানা কাহিনী তোমরা শোনাও সবে
মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে।
তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভূ নাহি হবে আর
আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার।
শস্য-শ্যামলা এই মাটি মা’র অঙ্গ পুষ্ট করে
আনিবে অটুট স্বাস্থ্য, সবল দেহ-মন ঘরে ঘরে।
তোমাদের গানে, কল-কলতানে উছসি উঠিবে নদী-
সরস করিয়া তৃণ ও তরুরে বহিবে সে নিরবধি
তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর
জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর।

Sunday, January 20, 2013

পাগলী, তোমার সঙ্গে

জয় গোস্বামী

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেবকাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু'কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল
বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙ্গব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।
মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে,
ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান লোকাসান
পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ
ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার
সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবনকাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব
প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ
বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র
কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবনকাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে 'কী মিথ্যুক'
কাটাব জীবন।
এক হাতে উপায় করব,
দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম লটারি,
তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন
কাটাব
লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।
দেখতে দেখতে পুজো আসবে,
দুনিয়া চিত্কার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব
রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাবজীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।
কবিত্ব ফুড়ুত্ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প
উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।
নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব
লুকিয়ে চুকিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে
বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভেবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপ বিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে র্ধমমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুবালা জীবন কাটাব
দুহে মিলে টিভি দেখব
হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
২১ টা উপশ থাকবে ২৬ ব্রত উৎযাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়াবাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে শেওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেলরুখ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপুর্না জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল
তুমি ঘর সাজাবে যাবতজীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীনব কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন
সন্ধাবেল ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্য রাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্রক্ষচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন
এর গায় কুনুই মারব, রাস্তা করব ওকে ধাক্কাদিয়ে
এটা ভাঙ্গলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু’দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভোর ভয়োঁ কাটাব জীবন।