Wednesday, February 22, 2012

কবর

জসীম উদ্দিন

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।

বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না হেস না মোন দাদু, সেই তামাক মাজন পায়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখি জলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝম নিরালা!
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদরি তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।

তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।

এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বাজান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শে শোয়া তার শেষ হবে তাহা কী জানিত কেউ?
গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!

তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জড়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিতে সারা দিনমান ভরি।
গাছের পাতার সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,
ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।

ঊদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর দেশের আন্ধারে ঘরে পথ পেয়েছিল খুজি।
তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই,
বড় ব্যথা রল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়ন জলে,
কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ ব্যথার ছলে।

ক্ষণপরে মোর ডাকিয়া কহিল আমার কবর গায়
স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।
সেই যে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু ছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনকি মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়;
বেহেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!
এখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে
দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।
শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ বীণ!
কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।

ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়।
আমার বুজীর তরেতে যেন গো বেস্ত নসিব হয়।

হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।

একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে।
কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাদু! ধর¬ধর¬ বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা কস নাকো, জাগিয়া উটিবে ঘুম¬ভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,

ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িত বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু ব্যথিত প্রাণ।

Friday, February 10, 2012

পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু


কবি: নির্মলেন্দু গুণ
আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা


একদি চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো
মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;
একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে,
একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।

একদি চুল কাটতে যাব না সেলুনে
একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো।
একদিন কালো চুলগুলো খ'সে যাবে,
কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।

একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে,
ট্রেনের টিকিট কেটে
একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না।
একদিন পরাজিত হবো।

একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি
কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।
একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে
পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।

একদিন সারাদিন কোথাও যাব না।

মায়ের কাছে চিঠি

তসলিমা নাসরিন
আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা

কেমন আছ তুমি? কতদিন, কত সহস্র দিন তোমাকে দেখি না মা, কত সহস্র দিন তোমার কন্ঠ শুনি না, কত সহস্র দিন কোনো স্পর্শ নেই তোমার। তুমি ছিলে, কখনও বুঝিনি ছিলে। যেন তুমি থাকবেই, যতদিন আমি থাকি ততদিন তুমি - যেন এরকমই কথা ছিল।

আমার সব ইচ্ছে মেটাতে যাদুকরের মত। কখন আমার ক্ষিদে পাচ্ছে, কখন তেষ্টা পাচ্ছে, কি পড়তে চাই, কী পরতে, কখন খেলতে চাই, ফেলতে চাই, মেলতে চাই হৃদয়,
আমি বোঝার আগেই বুঝতে তুমি।সব দিতে হাতের কাছে, পায়ের কাছে, মুখের কাছে। থাকতে নেপথ্যে। তোমাকে চোখের আড়ালে রেখে, মনের আড়ালে রেখে যত সুখ আছে সব নিয়েছি নিজের জন্য।

তোমাকে দেয়নি কিছু কেউ, ভালবাসেনি, আমিও দিইনি, বাসিনি। তুমি ছিলে নেপথ্যের মানুষ। তুমি কি মানুষ ছিলে? মানুষ বলে তো ভাবিনি কোনওদিন, দাসী ছিলে, দাসীর মত সুখের যোগান দিতে। যাদুকরের মত হাতের কাছে, পায়ের কাছে, মুখের কাছে যা কিছু চাই দিতে, না চাইতেই দিতে।

একটি মিষ্টি হাসিও তুমি পাওনি বিনিময়ে, ছিলে নেপথ্যে, ছিলে জাঁকালো উৎসবের বাইরে নিমগাছতলে অন্ধকারে, একা। তুমি কি মানুষ ছিলে ! তুমি ছিলে সংসারের খুঁটি,
দাবার ঘুঁটি, মানুষ ছিলে না।

তুমি ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে, ধোঁয়ার আড়ালে ছিলে, তোমার বেদনার ভার একাই বইতে তুমি, তোমার কষ্টে তুমি একাই কেঁদেছ। কেউ ছিল না তোমাকে স্পর্শ করার, আমিও না।
যাদুকরের মত সারিয়ে তুলতে অন্যের অসুখ-বিসুখ, তোমার নিজের অসুখ সারায়নি কেউ, আমি তো নইই, বরং তোমাকে, তুমি বোঝার আগেই হত্যা করেছি।

তুমি নেই, হঠাৎ আমি হাড়েমাংসেমজ্জায় টের পাচ্ছি তুমি নেই। যখন ছিলে, বুঝিনি ছিলে। যখন ছিলে, কেমন ছিলে জানতে চাইনি। তোমার না থাকার বিশাল পাথরের তলে
চাপা পড়ে আছে আমার দম্ভ।

যে কষ্ট তোমাকে দিয়েছি, সে কষ্ট আমাকেও চেয়েছি দিতে, পারিনি। কি করে পারব বল! আমি তো তোমার মত অত নিঃস্বার্থ নই, আমি তো তোমার মত অত বড় মানুষ নই।




আমাকে ভালোবাসার পর


কবি: হুমায়ুন আজাদ 
আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা


আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক'রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক'রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ'য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ'য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ'লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।

আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প'ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।

আমার সংসার

 নির্মলেন্দু গুণ
আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা

সংসার মানে সোনার কাঁকনে জীবনের রঙ লাগা,
সংসার মানে রক্তে-মাংসে সারারাত্তির জাগা।

সংসার মানে অপেক্ষমাণ একজোড়া চোখে দাবি,
সংসার মানে সাজানো ভুবন, আঁচলের খোঁটে চাবি।

সংসার মানে অনাগত শিশু, পুতুলে সাজানো ঘর,
সংসার মানে মনোহর নেশা, ঈশানে-বিষাণে ঝড়।

সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা, বেদনার জলাভূমি,
সংসার মানে সংসার ভাঙা, সংসার মানে তুমি।


সহজ

জীবনানন্দ দাশ

আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা 

আমার এ-গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে-
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,
তবুও হৃদয়ে গান আসে।
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমি-
তবু ভালোবাসা
জেগে থাকে প্রাণে;
পৃথিবীর কানে
নক্ষত্রের কানে
তবু গাই গান;
কোনোদিন শুনিবে না তুমি তাহা, জানি আমি-
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে-
তবুও হৃদয় গান আসে।

তুমি জল, তুমি ঢেউ- সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন
তোমার দেহের বেগ- তোমার সহজ মন
ভেসে যায় সাগরের জলের আবেগে;
কোন্ ঢেউ তার বুকে গিয়েছিলো লেগে
কোন্ অন্ধকারে
জানে না সে; রাত্রির সিন্ধুর জল
রাত্রির সিন্ধুর ঢেউ
তুমি এক; তোমারে কে ভালোবাসে; তোমারে কি কেউ
বুকে ক'রে রাখে ।
জলের আবেগে তুমি চ'লে যাও-
জলের উচ্ছাসে পিছে ধু-ধু জল তোমারে যে ডাকে।

তুমি শুধু একদিন, এক রজনীর;
মানুষের- মানুষীর ভিড়
তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে- কতো দূরে-
কোন্ সমুদ্রের পারে, বনে-মাঠে- কিংবা যে-আকাশ জুড়ে
উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে-
কিংবা যে-আকাশে
কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
জেগে ওঠে- ডুবে যায়- তোমার প্রাণের সাধ
তাহাদের তরে;
যেখানে গাছের শাখা নড়ে
শীত রাতে- মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন-
যেইখানে বন
আদিম রাত্রির ঘ্রাণ
বুকে ল'য়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান-
তুমি সেইখানে।
নিঃসঙ্গ বুকের গানে
নিশীথের বাতাসের মতো
একদিন এসেছিলে,
দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যতো।

সহজ 

নারী

কাজী নজরুল ইসলাম 

সাম্যের গান গাই-
   আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
   বিশ্বে যা-কিছু মহান্‌ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
   অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
   বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
   অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
   নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
   তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
   অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,
   ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
   এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
   নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
   তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছে যত ফল,
   অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
   জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী,
   সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
   পুরুষ এনেছে যামিনী-শানি-, সমীরণ, বারিবাহ!
   দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশীতে হ’য়েছে বধূ,
   পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
   শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
   নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
   নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
   ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।

       স্বর্ণ-রৌপ্যভার,
   নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার।
   নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
   যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
   নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
   জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে!
   জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
   মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্‌।
   কোন্‌ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
   কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
   কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
   বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
   কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
   প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।
   রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী,
   রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।

    পুরুষ হৃদয়-হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না’ক অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব,
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা,-
লব-কুশে বনে ত্যজিয়াছে রাম, পালন ক’রেছে সীতা।
নারী সে শিখা’ল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরা’ল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভুতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে ক’রে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ!
    তিনি নর-অবতার-
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর-
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।
    সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও , উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
     যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।

    শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্‌ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোম্‌টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর ক’রে দাও দাসীর চিহ্ন, যেথা যত আভরণ!

        ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হ’তে আছ মরি’
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি’!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের  ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
   সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

কবিঃ শামসুর রাহমান


তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিত্কার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝড়ে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে –
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।

Friday, February 3, 2012

দূরের পাল্লা

ছিপখান তিন-দাঁড়–
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা !
পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল,–জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নার টাঁকশাল ।

কঞ্চির তীর-ঘর
ঐ-চর জাগছে,
বন-হাঁস ডিম তার
শ্যাওলায় ঢাকছে ।

চুপ চুপ–ওই ডুব
দ্যায় পান্ কৌটি
দ্যায় ডুব টুপ টুপ
ঘোমটার বৌটি !

ঝকঝক কলসীর
বক্ বক্ শোন্ গো
ঘোমটার ফাঁক বয়
মন উন্মন গো ।

তিন-দাঁড় ছিপখান
মন্থর যাচ্ছে,
তিনজন মাল্লায়
কোন গান গাচ্ছে ?

রূপশালি ধান বুঝি
এইদেশে সৃষ্টি,
ধুপছায়া যার শাড়ী
তার হাসি মিষ্টি ।

মুখখানি মিষ্টিরে
চোখদুটি ভোমরা
ভাব-কদমের–ভরা
রূপ দেখ তোমরা !

ময়নামতীর জুটি
ওর নামই টগরী,
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে
জল হোলো গোখরী !

ডাক পাখী ওর লাগি’
ডাক ডেকে হদ্দ,
ওর তরে সোঁত-জলে
ফুল ফোটে পদ্ম ।

ওর তরে মন্থরে
নদ হেথা চলছে,
জলপিপি ওর মৃদু
বোল বুঝি বোলছে ।

দুইতীরে গ্রামগুলি
ওর জয়ই গাইছে,
গঞ্জে যে নৌকা সে
ওর মুখই চাইছে ।

আটকেছে যেই ডিঙা
চাইছে সে পর্শ,
সঙ্কটে শক্তি ও
সংসারে হর্ষ ।

পান বিনে ঠোঁট রাঙা
চোখ কালো ভোমরা,
রূপশালী-ধান-ভানা
রূপ দেখ তোমরা

বাবুরাম সাপুড়ে

সুকুমার রায়

বাবুরাম সাপুড়ে,
কোথা যাস বাপুরে

আয় বাবা দেখে যা,
দুটো সাপ রেখে যা -

যে সাপের চোখ নেই,
শিং নেই, নোখ নেই,

ছোটে না কি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না,

করে না কো ফোঁসফাঁস
মারে নাকো ঢুসঢাস,

নেই কোন উৎপাত,
খায় শুধু দুধভাত,

সেই সাপ জ্যান্ত,
গোটা দুই আন তো,

তেড়ে মেরে ডাণ্ডা
ক’রে দেই ঠাণ্ডা।

অগ্ন্যুৎসব


ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,
তোমার দিকে চোখ ছিলো না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।

আজকে আবার জীবন আমার ভিন্ন স্বপ্নে অংকুরিত অগ্ন্যুৎসবে
তোমাকে চায় শুধুই তোমায়।

রঙিন শাড়ির হলুদ পাড়ে ঋতুর প্লাবন নষ্ট করে
ভর দুপুরে শুধুই কেন হাত বেঁধেছো বুক ঢেকেছো
যুঁই চামেলী বেলীর মালায়,
আমার বুকে সেদিন যেমন আগুন ছিলো
ভিন্নভাবে জ্বলছে আজও,
তবু সবই ব্যর্থ হবে
তুমি কেবল যুঁই চামেলী বেলী ফুলেই মগ্ন হলে।

তার চেয়ে আজ এসো দু’জন জাহিদুরের গানের মতন
হৃদয় দিয়ে বোশেখ ডাকি, দু’জীবনেই বোশেখ আনি।
জানো হেলেন, আগুন দিয়ে হোলি খেলায় দারুন আরাম
খেলবো দু’জন এই শপথে
এসো স্ব-কাল শুদ্ধ করি দুর্বিনীত যৌবনেরে।


এতোটা জেনেও

আত্নগ্লানি বুকে নিয়ে ভেসে বেড়াই
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মত 
এতোটা জেনেও সুনন্দা ডাকেনা কাছে 
তবে পবিত্র আশ্রয় আমি কার কাছে পাব?
সরোবরে খেলা করে অধীশাওয়া

নত মুখে হেটে আসে আমার অদৃষ্ট 
আর ছিন্নভিন্ন স্মৃতি,

স্মৃতিচারণের চোখে চেয়ে দেখি 
অকর্মারমত লেগে আছে কপালের ঘামে 
সবুজাভ পাপ, শরীর ব্যর্থতা 
অথচ আশ্চর্য রোদে আবল্য সেই ছিল ধনুক শিকারি 
তন্ময় চোখ তুলে কতদিন করেছি জিজ্ঞাসা 
তুমি কারে ভালোবাসো?
শ্বেতবদ্য, সৈকত জোয়ার ?

সুনন্দা নিশ্চুপ ছিল সেই অলৌকিক ক্ষণে 
তাই চন্দ্রাভাঁড় সিঁড়ি বেয়ে 
রত্নগর্ভা রাতে নেমেছিল প্রবীণ সারস 
লক্ষ তারা নিভে গিয়ে হঠাৎ করে জ্বলে উঠেছিল 
শ্রাবস্তীর ঘরে চিত্রিত প্রদীপ 
আমি লোকাতীত শোকে সেই থেকে জ্বেলে রেখেছি খয়েরি লোবান,
শিওরে শিথানে সেই থেকে বুকে জেগে আছে শুরিত ব্যর্থটা 
তাই আজকাল নিয়মটি রেডিও শুনি,
শুনি রেণুকার খবর 
সব রেফারী খেলা ভুল করে বার বার 
অথচ ক্রন্দনরত চোখে মাঠ থেকে ফিরে যেতে হয় 
সব বন্ধন কেটে দিয়ে, 
ঘোরাতে হয় রেডিওর হলুদ নব উত্তরে পচ্চিমে 
যেখানে হা করে বসে আছে রৌরব নরকে 
আবার নিশ্চিত পরিত্রাণ৷
এতোটা জেনেও সুনন্দা ডাকেনা কাছে 
তবে পবিত্র আশ্রয় আমি কার কাছে পাব?
কার কাছে?


কোন কোন দিন




কোন কোন দিন
প্রিয় হয়ে ওঠে মাটি,
কোন কোন দিন
মানুষের কোলাহল।

কোন কোন দিন
প্রিয় হয়ে ওঠে নদী,
কোন কোন দিন
প্রিয় হয়ে ওঠে জল।
কোন কোন দিন
প্রিয় হয়ে উঠি আমি,
আমার দুঃক্ষ আমার দীর্ঘঃস্বাস।

কোন কোন দিন
প্রিয় হয়ে ওঠে শত্রু,
তুমি হয়ে ওঠো আমার সর্বনাশ।

কোন কোন দিন
প্রিয় হয়ে ওঠে ঘৃণ্য,
প্রিয় হয়ে ওঠে মৃত্যু।

কোন কোন দিন 
(নির্মলেন্দু গুণ)
আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা

শেষের কবিতা

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
 তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন-
 চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষ ফাটা তারার ক্রন্দন।
 ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল-
 তুলে নিল দ্রুত রথে
দুঃসাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
 পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখরচুড়ায়;
 রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দুর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
 হে বন্ধু বিদায়।
 কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
বসন-বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
 ঝরা বকুলের কান্না ব্যতিবে আকাশ,
 সেই ক্ষনে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রানে-; বিস্মৃতি প্রদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নের মুরতি।
 তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
 সব চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়-
 সে আমার প্রেম,
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই
ভেসে কালের যাত্রায়।
 হে বন্ধু, বিদায়।
 তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি।
 মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা-
 পুজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লানস্পর্শ লেগে;
 তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
 যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধুলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
 আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে রচন
 মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন।
 ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
 হে বন্ধু, বিদায়।
 মোর লাগি করিয়ো না শোক-
 আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
 মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যের করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
 উৎকন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
 সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
 রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
 যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
 তোমারে যা দিয়েছিনু তার
 পেয়েছে নিঃশেষ অধিকার।
 হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহুর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
 হৃদয় অঞ্জলি হতে মম।
ওমো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্য্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান;
 গ্রহন করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
 হে বন্ধু বিদায়