Tuesday, August 9, 2011

বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দিনের আলো নিবে এল,
সুয্যি ডোবে - ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে-
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা।
বাজল ঠঙ ঠঙ।
ও পারেতে বিষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা।
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশো মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান-

'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান'

আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা,
কোথায় বা সীমানা!
দেশে দেশে খেলে বেড়ায়,
কেউ করে না মানা।
কত নতুন ফুলের বনে
বিষ্টি দিয়ে যায়,
পলে পলে নতুন খেলা
কোথায় ভেবে পায়।
মেঘের খেলা দেখে কত
খেলা পড়ে মনে,
কত দিনের নুকোচুরি
কত ঘরের কোণে।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান-

'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান'

মনে পড়ে ঘরটি আলো
মায়ের হাসিমুখ,
মনে পড়ে মেঘের ডাকে
গুরুগুরু বুক।
বিছানাটির একটি পাশে
ঘুমিয়ে আছে খোকা,
মায়ের 'পরে দৌরাত্মি সে
না যায় লেখাজোখা।
ঘরেতে দুরন্ত ছেলে
করে দাপাদাপি,
বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে-
সৃষ্টি ওঠে কাঁপি।
মনে পড়ে মায়ের মুখে
শুনেছিলেম গান-

'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান'

মনে পড়ে সুয়োরানী
দুয়োরানীর কথা,
মনে পড়ে অভিমানী
কঙ্কাবতীর ব্যথা।
মনে পড়ে ঘরের কোণে
মিটিমিটি আলো,
একটা দিকের দেয়ালেতে
ছায়া কালো কালো।
বাইরে কেবল জলের শব্দ
ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ ঝুপ্‌-
দস্যি ছেলে গল্প শোনে
একেবারে চুপ।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে
মেঘলা দিনের গান-

'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান'

কবে বিষ্টি পড়েছিল,
বান এল সে কোথা।
শিবঠাকুরের বিয়ে হল,
কবেকার সে কথা।
সেদিনও কি এম্‌নিতরো
মেঘের ঘটাখানা।
থেকে থেকে বাজ বিজুলি
দিচ্ছিল কি হানা।
তিন কন্যে বিয়ে করে
কী হল তার শেষে।
না জানি কোন্‌ নদীর ধারে,
না জানি কোন্‌ দেশে,
কোন্‌ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে
কে গাহিল গান-

'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান'

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর


আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা

চিঠি

 বুদ্ধদেব গুহ

কুরচি,
তোমার চিঠি হঠাৎ এই শীতের সকালে এক রাশ উষ্ণতা বয়ে আনলো। পাতা ঝরে যাচ্ছে সামনের শালবনে, বিবাগী হচ্ছে বগি। রিক্ততার দিন আসছে সামনে। এরই মধ্যে তোমার চিঠি যৌবনের ধুতির মত এলো এক ঝাঁক টিয়ার উল্লাসিত সমস্ত সবুজ চিৎকারের মত। তার মানে এই নয় যে- তোমার চিঠি দুর্বোধ্য। উপমার খোদ ক্ষমা করে দিও। কেমন আছ তুমি? জানতে চাইলেও জানতে পাই কই?

সকাল থেকেই তোমাকে আজ খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছিল। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুম ভাঙ্গলো বড় এক চমকে। এক জোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। যে পাখিদের ডাক বড় একটা শুনিনি এদিকে। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি- এক জোড়া স্কারলেট মিনি-ভেট এসে বসেছে আম গাছের মাথায়।আমার ঘুম ভাঙ্গা নিয়ে পাখিরা- আহা রোজই যদি আসতো। আর তারপরই তোমার এই চিঠি। দিন আজকে ভালো যাবে আমার।

বলছিলাম যে, সকাল থেকেই তোমাকে সুন্দর একটি চিঠি লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু সুন্দর সুখের যা কিছু ইচ্ছা তা দমন করার মধ্যেও বোধহয় এক ধরনের গভীরতর সুখ নিহীত থাকে। থাকে না? আজ চিঠি লিখবোনা তোমাকে, তার বদলে একটি স্বপ্নহার পাঠাচ্ছি, লেখক কবি না তবুও তার নাম গোপন থাক। কি যে দেখেছিলাম তোমার ঐ মুখটিতে কুরচি। এত যুগ ধরে কত মুখইতো দেখলো এই পোড়া চোখ দু'টি। কিন্তু, কিন্তু এমন করে আর কোনো মুখ'এইতো আমার সর্বস্বকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেনি। ভালো না বাসলেই ভালো...... বড় কস্ট ভালোবাসায়।

কুরচি দেখি কি করতে পারি? তোমার সাথে বেড়াতে যাবার। ইচ্ছে তো কত কিছুই করে। এই জীবনে ক'টি ইচ্ছে পুণ্য হলো বলো? কারই'বা হয়? এমনিতে আমার অনেক কষ্ট। এমন করে ডাক পাঠিয়ে আর কষ্ট বারিওনা। একা একা মজা করতেও বিবেকে লাগে। যার বিবেক বেচে থাকে, তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক বিবশ হলেই বাঁচি।

ভালো থেকো
তোমার প্রিথু দা

মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়


জয় গোস্বামী

বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাব
বেণীমাধব তুমি কি আর আমার কথা ভাব?
বেণীমাধব মোহন বাঁশি তমাল তরু মূলে
বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী স্কুলে।
ডেস্কে বসে অংক করি, ছোট্ট ক্লাস ঘর
বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর।
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি,
আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি।

বেণীমাধব, বেণীমাধব, পড়াশুনায় ভাল
শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রঙ কালো।
তোমায় দেখে পালিয়ে গেছি একদৌড়ে ঘরে
বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে।
কু্ন্জে তবু গু্ন্জে অলি ফুটেছে মন্জরী
সন্ধ্যা বেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি।
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোলো
ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হলো।

বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতোদিনের পরে
সেসব কথা এখনো কি আর তোমার মনে পড়ে?
সেসব কথা বলেছ কি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল এ একটিবার তোমার পাশে তাকে,
দেখেছিলাম আলোর নীচে, অপূ্র্ব সে আলো।
স্বীকার করি দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো।
জুড়িয়ে দিল চোখ আমার, পুড়িয়ে দিল চোখ
বাড়ীতে এসে বলেছিলাম - ওদের ভালো হোক।

রাতে এখন ঘুমোতে যাই - একতলার ঘরে
মেঝের পরে বিছানা পাতা, জো্ত্স্না এসে পড়ে।
আমার পরে যে বোন ছিল, চোরাপথের বাঁকে
হারিয়ে গেছে, জানি না আজ কার সঙ্গে থাকে।
আজ জুটেছে? কাল কি হবে? আমার ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ায় সেলাই দিদিমণি।

তবু, আগুন - বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?

সিন্ধুসারস

দু-এক মুহূর্তে শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি
হে সিন্ধুসারস,
মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি
নাচিতেছে টারান্‌টেলা- রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি
চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দু'টি আকাশের গায়
ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়।
মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান,
আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ
নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ
পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান
শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান।
জানো কি অনেক যুগ চ'লে গেছে? ম'রে গেছে অনেক নৃপতি?
অনেক সোনার ধার ঝ'রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি
আমাদের ক্লান্ত ক'রে দিয়ে গেছে- হারায়েছি আনন্দের গতি;
ইচ্ছা, ছিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান- এই বর্তমান
হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের- বেদনার আমার সন্তান?
জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেলার সন্তান,
তুমি পিছে চাহো নাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই,
বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর
পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে
ব্যথা আর কুয়াশার ঘর।
যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পণার নিঃসঙ্গ প্রভাত
নেই তব; নেই নিম্নভূমি- নেই আনন্দের অন্তরালে
প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত।
স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো- পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা
বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা
রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতো রেখা
প্রাণে তার- ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো;
একবার স্বপনে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো
নিভে গেছে তুমি সপ্ন দেখো নাক; যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, ক'রে না বুনন
মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ'রে ওঠে শালিকের মন,
মেঘের দুপুর ভাসে- সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন
মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে;
সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে।

আমি তোমাকেই বলে দেব

আমি তোমাকেই বলে
দেব কী যে একা দীর্ঘ রাত
আমি হেটে গেছি বিরান পথে
আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়-
ছুয়ে কান্নার রঙ
ছুয়ে জোছনার ছায়া


আমি কাউকে বলিনি সে নাম
কেউ জানেনা, না জানে আড়াল
জানে কান্নার রঙ
জানে জোছনার ছায়া


তবে এই হোক, তীরে জাগুক প্লাবন
দিন হোক লাবন্য, হ্রদয়ে শ্রাবন
তুমি কান্নার রঙ
তুমি জোছনার ছায়া