Tuesday, March 30, 2010

এক গায়েঁ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.................
আমরা দু'জন একটি গাঁয়ে থাকি
সে আমাদের একটিমাত্র সুখ
তাদের গাছে গায়যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক ।
তাহার দু'টি পালন করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙ্গে আমার ক্ষেতের বেড়া
কোলের পরে নেই তাহারে তুলে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

দুইটি পাড়ায় বড়ই কাছাকাছি
মাঝখানে শুধু একটি মাঠের ফাঁক
তাদের বনের অনেক মধু-মাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক।
তাদের ঘাটের পূজার জবা মালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে
তাদের পাড়ার কুসুম ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

আমাদের এই গ্রামের গলি পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন
তাদের ক্ষেতে যখন তিসি ধরে
মোদের ক্ষেত তখন ফোটে শন ।
তাদের ছাদে যখন উঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ-ধারা
আমার বনে কদম ফোটে ওঠে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।



Monday, March 29, 2010

আট বছর আগে একদিন



জীবনানন্দ দাশ

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ।
বধু শূয়েছিল পাশে, শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল - জোছনায় - তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেংগে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার ।


এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি !
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইদুরের মত ঘাড় গুজি
আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার ;
কোনদিন জাগিবে না আর ।

‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর -’
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে ।
তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাংগ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
কয়েক্টি প্রভাতের ইশারায় -অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে ।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থাকে জীবনের স্রোত ভালবেসে ।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি ;
সোনালী রোদের ঢেইয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি ।
ঘনিষ্ট আকাশ যেন, কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছ ইহাদের মন ।;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িংযের ঘন শিহরন
মরনের সাথে লড়িয়াছে ।
চাঁদ ডুবে গেলে প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে নিয়ে গিয়েছিলে তবু একা একা,
যে জীবন ফড়িংযের দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা ,
- এই জেনে ।

অশ্বথের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকীর ভিড় এসে
সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাকে
করে নি কি মাখা মাখি ?
থুর থুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলে নি কি ‘ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! —
ধরা যাক দুই একটা ইদুর এবার !’
জানায় নি কি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার ?
জীবনের এই স্বাদ - সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের -
তোমার অসহ্য বোধ হল;
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো
মর্গে - গুমোটে
থ্যাঁতা ইদুরের মত রক্তমাখা ঠোটে !

শোনো
তবুও এ মৃতের গল্প; - কোন
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই ;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোন খাদ ।
সময়ের উদবর্তনে উঠে আসে বধু
মধু - আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাঢ়াভাতের গ্লানি কোন বেদনার শীতে
এ জীবন কোন দিন কেপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শূয়ে আছে টেবিলের ‘পরে ।

জানি - তবু জানি
নারীর হৃদয় - প্রেম -শিশূ - গৃহ- নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় -
আরো এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে ;
লাশ কাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই,
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শূয়ে আছে টেবিলের ‘পরে ।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয়ঃ ‘ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! —
ধরা যাক দুই একটা ইদুর এবার –!’

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব - বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

যে আমাকে প্রেম শেখালো


মাকিদ হায়দার

যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে

সে যেন আজ রানীর মত
ব্যক্তিগত রাজ্যপাটে
পা ছড়িয়ে সবার কাছে
বসতে পারে
বলতে পারে মনের কথা
চোখের তারায়
হাত ইশারায়

ঐ যে দেখ দুঃখি প্রেমিক
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর
ভিক্ষে দিলে ভিক্ষে নেবে
ছিন্ন বাসে শীর্ন দেহে
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর

কিন্তু শোন প্রজাবৃন্দ
দুঃসময়ে সেই তো ছিলো
বুকের কাছে হৃদয় মাঝে
আজকে তারে দেখলে শুধু
ইচ্ছে করে
চোখের পাতায় অধর রাখি

যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে চিনিয়েছিলো
দুষ্টু গ্রহ অরুন্ধতী
বৃষ্টি ভেজা চতুর্দশী
জোৎস্না রাতের উজ্জ্বলতা
ভোরের বকুল শুভ্র মালা
নগর নাগর ভদ্র ইতর
রাজার বাড়ি
সেই তো আবার বুঝিয়েছিলো

যাওগো চলে আমায় ছেড়ে

যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে

নিজের দেহে আগুন জ্বেলে
ভেবেছিলাম
নিখাদ সোনা হবোই আমি
শীত বিকেলের টুকরো স্মৃতি
রাখবো ধরে সবার মত
হৃদয় বীণার মোহন তারে
ভুলেই গেলাম
যখন তুমি আমায় ডেকে
বললে শুধু

পথের এখন অনেক বাকি
যাও গো শোভন
যাও গো চলে বহুদুরে
কণ্ঠে আমার অনেক তৃষা
যাও গো চলে আপন পথে

এই না বলেই
হাসলে শুধু করুন ঠোঁটে
বাজলো দুরে শঙ্খ নিনাদ
কাঁদলো আমার বুকের পাথর
কাঁদলো দুরে হাজার তারা
একলা থাকার গভীর রাতে
একলা জাগার তিন প্রহরে

তাইতো বলি সবার কাছে
যে আমাকে দুঃখ দিলো
সে যেন আজ সবার চেয়ে
সুখেই থাকে
যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে বুকের মাঝে
অনল দিলো
সে যেন আজ সবার চেয়ে
সুখেই থাকে

সুখেই থাকে।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

তুই কি আমার দুঃখ হবি?


আনিসুল হক

তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া।
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি।

তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
নিজের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।

তুই কি একা আমার হবি?
তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

তোমাকে চাই


সুমন চট্টোপাধ্যায়

প্রথমত, আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত, আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত, আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।।
নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই
রাতভোর হলে আমি তোমাকে চাই
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই
সন্ধের অবকাশে তোমাকে চাই।।
বৈশাখী ঝড়ে আমি তোমাকে চাই
আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই
শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই
অকালবোধনে আমি তোমাকে চাই।।
কবেকার কলকাতা শহরের পথে
পুরোনো নতুন মুখ ঘরে ইমারতে
অগুন্তি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে
অচেনা ছুটির ছোঁয়া তুমি এনে দিলে
নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই
এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই
বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই
এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই।।
চৌরাস্তার মোড়ে পার্কে দোকানে
শহরে গঞ্জে গ্রামে এখানে ওখানে
স্টেশন টার্মিনাস ঘাটে বন্দরে
অচেনা ড্রয়িংরুমে চেনা অন্দরে
বালিশ তোশক কাঁথা পুরোনো চাদরে
ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে
কড়িকাঠে চৌকাঠে মাদুরে পাপোশে
হাসি রাগ অভিমানে ঝগড়া আপোসে
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই
না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই।।
শীর্ষেন্দুর কোন নতুন নভেলে
হঠাৎ পড়তে বসা আবোলতাবোলে
অবোধ্য কবিতায় ঠুংরি খেয়ালে
স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেয়ালে দেয়ালে।।
সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে
চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত প্রাণে
ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে
কোন্ কবেকার অনুরোধের আসরে
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
অনুরোধে মিনতিতে তোমাকে চাই
বেদনার আর্তিতে তোমাকে চাই
দাবীদাওয়া চাহিদায় তোমাকে চাই
লজ্জাদ্বিধায় আমি তোমাকে চাই
অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবীতে
সারারাত জেগে আঁকা লড়াকু ছবিতে
ছিপছিপে কবিতার ছন্দে ভাষায়
গদ্যের যুক্তিতে বাঁচার আশায়
শ্রেণীহীন সমাজের চির বাসনায়
দিনবদলের খিদে ভরা চেতনায়
দ্বিধাদ্বন্দের দিন ঘোচার স্বপ্নে
সাম্যবাদের গান ঘুমে জাগরণে
বিক্ষোভে বিপ্লবে তোমাকে চাই
ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই
শান্তি অশান্তিতে তোমাকে চাই
এই বিভ্রান্তিতে তোমাকে চাই।।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

মন ভালো নেই


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি সুরা এমনকি ভাষা
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়



Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

Friday, March 12, 2010

কষ্ট নেবে কষ্ট


হেলাল হাফিজ


কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
মাল্টি কালার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
তাসের খেলায় দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট।

আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট



Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

প্রতিদান



জসীমউদ্দীন


আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হয়েছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর ।
আমার একুল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষ ভরা বান,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান;
কাটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাদিঁয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর ।
মোর বুকে যেবা কবর বেধেছে আমি তার বুক ভরি,
রঙ্গীন ফুলের সোহাগ জড়ান ফুল মালঞ্চ ধরি।
যে মুখে সে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে সখী, তারি মুখ খানি,
কত ঠাই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর,
আপন করিতে কাদিয়া বেড়াই যে মোরে করিয়াছে পর ।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

আমি হয়তো মানুষ নই


নির্মলেন্দু গুণ


আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।


আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তfও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।


আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।


আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।


মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।


আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

বৃষ্টি মানে


মোফাজ্জেল করিম


বৃষ্টি মানেই বুকের ভেতর কর্ষিত মাঠ ওলোট পালোট।
হালট ডালট উপচে ওঠার ভরা কটাল।
বৃষ্টি মানেই সর্ষ ক্ষেতে মিলন সুখে গর্ভধারণ।
নিভৃতে তার মনের ভেতর গোলাপ ফোঁটার পরাগায়ণ।

বৃষ্টি মানে শুভ্র তনু, উষ্ণ শীতল পূর্ণিমা চাঁদ,
অষ্টপ্রহর পলকবিহীন দেখছি কেবল, দেখছি কেবল।
বৃষ্টি মানেই টেনে টুনে একটি কাথায় সহমরণ।

বৃষ্টি মানেই নষ্ট প্যাঁচ এক ত্যাগ গড়িয়ে অথৈ পুকুর দুঃখবিলাস।
কখনও বা দুঃখ ঝরে টাপুসটুপুস ভীষণ গোপন।
বৃষ্টি মানে সত্যি করে মন খারাপের প্রাচীন প্রহর।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

রূপসী বাংলা


জীবনানন্দ দাশ

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েলপাখি — চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম — বট — কাঠালের — হিজলের — অশখের করে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল — বট — তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ

দেখেছিল; বেহুলার একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে –
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চরায় –
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিলো — একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিলো ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।
--------------------------------------------
এই পৃথিবীতে এক

এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, - সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্ণীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;

সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর –
শঙ্খমালা নাম তার : এ- বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।
------------------------------------------

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে-একবার — দুইবার — তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;
দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ — শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে
শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে,

খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্‌ কাহিনীর দেশে –
‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,
কল্‌মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীরে –
নীরবে পা ধোয় জলে একবার — তারপর দূরে নিরুদ্দেশে
চ’লে যায় কুয়াশায় — তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে
হারাব না তারে আমি — সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।
------------------------------------------

তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে

তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে তোমার সন্তান
বাংলার বুক ছেড়ে চলে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে,
আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে
ডুবে যায়, – কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে-দিকে রপশালী ধান
একদিন; – হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান,
আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে –
হ্নদয়ে ক্ষদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্খার তবু ও তো চোখের উপরে
নীল, মৃত্যু উজাগর – বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ -

কখন মরণ আসে কে বা জানে – কালীদহে কখন যে ঝড়
কমলের নাম ভাঙে – ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিকের প্রাণ
জানি নাকো;- তবু যেন মরি আমি এই মাঠ – ঘাটের ভিতর,
কৃষ্ণা যমুনায় নয় – যেন এই গাঙুড়ের ডেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখে মুখে – রুপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।
---------------------------------------

একদিন কুয়াশার এই মাঠে


একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন — গিয়েছে যে শান — হিম ঘরে,
অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল — পৃথিবীর এই মাঠখানি
ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে

আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে,
আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে আজো চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?

সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে নাকি জামের নিবিড় ঘন ডালে,
মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে –
কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে
মধুর চাকের নিচে — মাছিগুলো উড়ে যায়… ঝ’রে পড়ে… ম’রে থাকে ঘাসে –
--------------------------------------------------
আবার আসিব ফিরে

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা রায় — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে –


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA