Tuesday, November 30, 2010

আকাশলীনা


সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনাঃ
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;


ফিরে এসো এই মাঠে , ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূর - আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।


কী কথা তাহার সাথে? -তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মত তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস:
বাতাসের ওপারে বাতাস
-আকাশের ওপারে আকাশ।



Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

Friday, November 26, 2010

কৃষ্ণকলি


কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের'পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

পূবে বাতাস এল হঠাত্‍‌ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে, আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

এমনি করে কাজল কালো মেঘ জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ়মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাত্‍‌ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।




Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

কেউ দেখেনি



কৃষ্ণকলি কেউ বলে না তাকে
কালো তাকে বলে পাড়ার লোক
মেঘলা কোথা, সব ক'টা দিন খরা
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ
বাপের তার নেইকো টাকা মোটে
অর্থ ছাড়া পাত্র কোথা জোটে?
কালো তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ

লোডসেডিং-এ আধার হলো দেখে
পাত্র পক্ষ করছিলো যাই যাই
কালো মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
ভেতর হতে ত্রস্তে এলো তাই
ছেলের বাবা কোঁচকালো তার ভুরু
মেয়ের বুক কাঁপলো দুরু দুরু
কালোই - তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ।

পূবে বাতাস এলো হঠাৎ ধেয়ে
বোগেন ভিলায় খেলিয়ে গেলো ঢেউ
জানলা ধারে দাঁড়িয়ে মেয়ে একা
রাস্তা ধারে ছিলো অনেক কেউ
তার পানে কেউ দেখলো কিনা চেয়ে
শংকা বুকে ট্যারিয়ে দেখে মেয়ে
কালোই - তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ।

পার হয়ে যায় মাসির কালো মেয়ে
জৈষ্ঠ মাসে কয়েক হাজার পণে
কোথায় একা কাকার মেয়ে কাজল
আষাঢ় মাসে পালায় সংগোপনে
যখন একা শ্রাবণ রজনীতে
কোন ভাবনা ঘনায় মেয়ের জিতে?
কালো তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ

কৃষ্ণকলি কেউ বলে না তাকে
কালো তাকে বলে পাড়ার লোক
দেখেছিলেম সিলিং থেকে ঝোলা
কালো মেয়ের বিস্ফোরিত চোখ
কিচ্ছু বোঝার দেয়নি অবকাশ
শাড়িই খানি হলো গলার ফাঁস
কালোই - তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখেনি কালো হরিণ চোখ


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

Saturday, November 13, 2010

রানার


সুকান্ত ভট্টাচার্য

রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।

রানার ! রানার !
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দূর্বার দূর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মত পিছে সরে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ-বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ।
অবাক রাতের তারারা আকাশে মিটমিট করে চায়;
কেমন ক'রে এ রানার সবেগে হরিণের মত ধায় !
কত গ্রাম, কত পথ যায় স'রে স'রে
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন্ জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো।

এমনি ক'রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে 'মেলে'।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখ, বহু বেদনায়, অভিমানে অনুরাগে
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।
রানার ! রানার !
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে ?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে ?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে
কত চিঠি লেখে লোকে-
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেমন, জানবে পথের তৃণ
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই পাঠাবে সহানুভূতির খামে-
রানার ! রানার ! কী হবে এ বোঝা ব'য়ে।
কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিকে ক্ষ'য়ে ক্ষ'য়ে ?
রানার ! রানার ! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল,
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল ?
রানার ! গ্রামের রানার !
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চল আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে-
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর
অগ্রগতির 'মেলে',
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-
নেই, দেরী নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো, আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার।।

রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।

রানার ! রানার !
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দূর্বার দূর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মত পিছে সরে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ-বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ।
অবাক রাতের তারারা আকাশে মিটমিট করে চায়;
কেমন ক'রে এ রানার সবেগে হরিণের ম ধায় !
কত গ্রাম, কত পথ যায় স'রে স'রে
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন্ জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো।

এমনি ক'রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে 'মেলে'।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখ, বহু বেদনায়, অভিমানে অনুরাগে
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।
রানার ! রানার !
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে ?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে ?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে
কত চিঠি লেখে লোকে-
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেমন, জানবে পথের তৃণ
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই পাঠাবে সহানুভূতির খামে-
রানার ! রানার ! কী হবে এ বোঝা ব'য়ে।
কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিকে ক্ষ'য়ে ক্ষ'য়ে ?
রানার ! রানার ! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল,
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল ?
রানার ! গ্রামের রানার !
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চল আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে-
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর
অগ্রগতির 'মেলে',
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-
নেই, দেরী নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো, আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার।।



Tuesday, March 30, 2010

এক গায়েঁ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.................
আমরা দু'জন একটি গাঁয়ে থাকি
সে আমাদের একটিমাত্র সুখ
তাদের গাছে গায়যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক ।
তাহার দু'টি পালন করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙ্গে আমার ক্ষেতের বেড়া
কোলের পরে নেই তাহারে তুলে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

দুইটি পাড়ায় বড়ই কাছাকাছি
মাঝখানে শুধু একটি মাঠের ফাঁক
তাদের বনের অনেক মধু-মাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক।
তাদের ঘাটের পূজার জবা মালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে
তাদের পাড়ার কুসুম ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

আমাদের এই গ্রামের গলি পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন
তাদের ক্ষেতে যখন তিসি ধরে
মোদের ক্ষেত তখন ফোটে শন ।
তাদের ছাদে যখন উঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ-ধারা
আমার বনে কদম ফোটে ওঠে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।



Monday, March 29, 2010

আট বছর আগে একদিন



জীবনানন্দ দাশ

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ।
বধু শূয়েছিল পাশে, শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল - জোছনায় - তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেংগে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার ।


এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি !
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইদুরের মত ঘাড় গুজি
আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার ;
কোনদিন জাগিবে না আর ।

‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর -’
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে ।
তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাংগ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
কয়েক্টি প্রভাতের ইশারায় -অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে ।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থাকে জীবনের স্রোত ভালবেসে ।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি ;
সোনালী রোদের ঢেইয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি ।
ঘনিষ্ট আকাশ যেন, কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছ ইহাদের মন ।;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িংযের ঘন শিহরন
মরনের সাথে লড়িয়াছে ।
চাঁদ ডুবে গেলে প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে নিয়ে গিয়েছিলে তবু একা একা,
যে জীবন ফড়িংযের দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা ,
- এই জেনে ।

অশ্বথের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকীর ভিড় এসে
সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাকে
করে নি কি মাখা মাখি ?
থুর থুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলে নি কি ‘ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! —
ধরা যাক দুই একটা ইদুর এবার !’
জানায় নি কি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার ?
জীবনের এই স্বাদ - সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের -
তোমার অসহ্য বোধ হল;
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো
মর্গে - গুমোটে
থ্যাঁতা ইদুরের মত রক্তমাখা ঠোটে !

শোনো
তবুও এ মৃতের গল্প; - কোন
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই ;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোন খাদ ।
সময়ের উদবর্তনে উঠে আসে বধু
মধু - আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাঢ়াভাতের গ্লানি কোন বেদনার শীতে
এ জীবন কোন দিন কেপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শূয়ে আছে টেবিলের ‘পরে ।

জানি - তবু জানি
নারীর হৃদয় - প্রেম -শিশূ - গৃহ- নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় -
আরো এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে ;
লাশ কাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই,
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শূয়ে আছে টেবিলের ‘পরে ।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয়ঃ ‘ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! —
ধরা যাক দুই একটা ইদুর এবার –!’

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব - বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

যে আমাকে প্রেম শেখালো


মাকিদ হায়দার

যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে

সে যেন আজ রানীর মত
ব্যক্তিগত রাজ্যপাটে
পা ছড়িয়ে সবার কাছে
বসতে পারে
বলতে পারে মনের কথা
চোখের তারায়
হাত ইশারায়

ঐ যে দেখ দুঃখি প্রেমিক
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর
ভিক্ষে দিলে ভিক্ষে নেবে
ছিন্ন বাসে শীর্ন দেহে
যাচ্ছে পুড়ে রোদের ভিতর

কিন্তু শোন প্রজাবৃন্দ
দুঃসময়ে সেই তো ছিলো
বুকের কাছে হৃদয় মাঝে
আজকে তারে দেখলে শুধু
ইচ্ছে করে
চোখের পাতায় অধর রাখি

যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে চিনিয়েছিলো
দুষ্টু গ্রহ অরুন্ধতী
বৃষ্টি ভেজা চতুর্দশী
জোৎস্না রাতের উজ্জ্বলতা
ভোরের বকুল শুভ্র মালা
নগর নাগর ভদ্র ইতর
রাজার বাড়ি
সেই তো আবার বুঝিয়েছিলো

যাওগো চলে আমায় ছেড়ে

যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে

নিজের দেহে আগুন জ্বেলে
ভেবেছিলাম
নিখাদ সোনা হবোই আমি
শীত বিকেলের টুকরো স্মৃতি
রাখবো ধরে সবার মত
হৃদয় বীণার মোহন তারে
ভুলেই গেলাম
যখন তুমি আমায় ডেকে
বললে শুধু

পথের এখন অনেক বাকি
যাও গো শোভন
যাও গো চলে বহুদুরে
কণ্ঠে আমার অনেক তৃষা
যাও গো চলে আপন পথে

এই না বলেই
হাসলে শুধু করুন ঠোঁটে
বাজলো দুরে শঙ্খ নিনাদ
কাঁদলো আমার বুকের পাথর
কাঁদলো দুরে হাজার তারা
একলা থাকার গভীর রাতে
একলা জাগার তিন প্রহরে

তাইতো বলি সবার কাছে
যে আমাকে দুঃখ দিলো
সে যেন আজ সবার চেয়ে
সুখেই থাকে
যে আমাকে প্রেম শেখালো
প্রেম শিখিয়ে বুকের মাঝে
অনল দিলো
সে যেন আজ সবার চেয়ে
সুখেই থাকে

সুখেই থাকে।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

তুই কি আমার দুঃখ হবি?


আনিসুল হক

তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া।
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি।

তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
নিজের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।

তুই কি একা আমার হবি?
তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

তোমাকে চাই


সুমন চট্টোপাধ্যায়

প্রথমত, আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত, আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত, আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।।
নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই
রাতভোর হলে আমি তোমাকে চাই
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই
সন্ধের অবকাশে তোমাকে চাই।।
বৈশাখী ঝড়ে আমি তোমাকে চাই
আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই
শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই
অকালবোধনে আমি তোমাকে চাই।।
কবেকার কলকাতা শহরের পথে
পুরোনো নতুন মুখ ঘরে ইমারতে
অগুন্তি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে
অচেনা ছুটির ছোঁয়া তুমি এনে দিলে
নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই
এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই
বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই
এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই।।
চৌরাস্তার মোড়ে পার্কে দোকানে
শহরে গঞ্জে গ্রামে এখানে ওখানে
স্টেশন টার্মিনাস ঘাটে বন্দরে
অচেনা ড্রয়িংরুমে চেনা অন্দরে
বালিশ তোশক কাঁথা পুরোনো চাদরে
ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে
কড়িকাঠে চৌকাঠে মাদুরে পাপোশে
হাসি রাগ অভিমানে ঝগড়া আপোসে
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই
না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই।।
শীর্ষেন্দুর কোন নতুন নভেলে
হঠাৎ পড়তে বসা আবোলতাবোলে
অবোধ্য কবিতায় ঠুংরি খেয়ালে
স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেয়ালে দেয়ালে।।
সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে
চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত প্রাণে
ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে
কোন্ কবেকার অনুরোধের আসরে
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
অনুরোধে মিনতিতে তোমাকে চাই
বেদনার আর্তিতে তোমাকে চাই
দাবীদাওয়া চাহিদায় তোমাকে চাই
লজ্জাদ্বিধায় আমি তোমাকে চাই
অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবীতে
সারারাত জেগে আঁকা লড়াকু ছবিতে
ছিপছিপে কবিতার ছন্দে ভাষায়
গদ্যের যুক্তিতে বাঁচার আশায়
শ্রেণীহীন সমাজের চির বাসনায়
দিনবদলের খিদে ভরা চেতনায়
দ্বিধাদ্বন্দের দিন ঘোচার স্বপ্নে
সাম্যবাদের গান ঘুমে জাগরণে
বিক্ষোভে বিপ্লবে তোমাকে চাই
ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই
শান্তি অশান্তিতে তোমাকে চাই
এই বিভ্রান্তিতে তোমাকে চাই।।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

মন ভালো নেই


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি সুরা এমনকি ভাষা
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়



Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

Friday, March 12, 2010

কষ্ট নেবে কষ্ট


হেলাল হাফিজ


কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
মাল্টি কালার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
তাসের খেলায় দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট।

আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট



Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

প্রতিদান



জসীমউদ্দীন


আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হয়েছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাধি তার ঘর ।
আমার একুল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষ ভরা বান,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান;
কাটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাদিঁয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর ।
মোর বুকে যেবা কবর বেধেছে আমি তার বুক ভরি,
রঙ্গীন ফুলের সোহাগ জড়ান ফুল মালঞ্চ ধরি।
যে মুখে সে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে সখী, তারি মুখ খানি,
কত ঠাই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর,
আপন করিতে কাদিয়া বেড়াই যে মোরে করিয়াছে পর ।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

আমি হয়তো মানুষ নই


নির্মলেন্দু গুণ


আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।


আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তfও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।


আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।


আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।


মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।


আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

বৃষ্টি মানে


মোফাজ্জেল করিম


বৃষ্টি মানেই বুকের ভেতর কর্ষিত মাঠ ওলোট পালোট।
হালট ডালট উপচে ওঠার ভরা কটাল।
বৃষ্টি মানেই সর্ষ ক্ষেতে মিলন সুখে গর্ভধারণ।
নিভৃতে তার মনের ভেতর গোলাপ ফোঁটার পরাগায়ণ।

বৃষ্টি মানে শুভ্র তনু, উষ্ণ শীতল পূর্ণিমা চাঁদ,
অষ্টপ্রহর পলকবিহীন দেখছি কেবল, দেখছি কেবল।
বৃষ্টি মানেই টেনে টুনে একটি কাথায় সহমরণ।

বৃষ্টি মানেই নষ্ট প্যাঁচ এক ত্যাগ গড়িয়ে অথৈ পুকুর দুঃখবিলাস।
কখনও বা দুঃখ ঝরে টাপুসটুপুস ভীষণ গোপন।
বৃষ্টি মানে সত্যি করে মন খারাপের প্রাচীন প্রহর।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

রূপসী বাংলা


জীবনানন্দ দাশ

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েলপাখি — চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম — বট — কাঠালের — হিজলের — অশখের করে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল — বট — তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ

দেখেছিল; বেহুলার একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে –
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চরায় –
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিলো — একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিলো ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।
--------------------------------------------
এই পৃথিবীতে এক

এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, - সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্ণীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;

সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর –
শঙ্খমালা নাম তার : এ- বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।
------------------------------------------

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে-একবার — দুইবার — তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;
দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ — শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে
শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে,

খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্‌ কাহিনীর দেশে –
‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,
কল্‌মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীরে –
নীরবে পা ধোয় জলে একবার — তারপর দূরে নিরুদ্দেশে
চ’লে যায় কুয়াশায় — তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে
হারাব না তারে আমি — সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।
------------------------------------------

তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে

তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে তোমার সন্তান
বাংলার বুক ছেড়ে চলে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে,
আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে
ডুবে যায়, – কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে-দিকে রপশালী ধান
একদিন; – হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান,
আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে –
হ্নদয়ে ক্ষদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্খার তবু ও তো চোখের উপরে
নীল, মৃত্যু উজাগর – বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ -

কখন মরণ আসে কে বা জানে – কালীদহে কখন যে ঝড়
কমলের নাম ভাঙে – ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিকের প্রাণ
জানি নাকো;- তবু যেন মরি আমি এই মাঠ – ঘাটের ভিতর,
কৃষ্ণা যমুনায় নয় – যেন এই গাঙুড়ের ডেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখে মুখে – রুপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।
---------------------------------------

একদিন কুয়াশার এই মাঠে


একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন — গিয়েছে যে শান — হিম ঘরে,
অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল — পৃথিবীর এই মাঠখানি
ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে

আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে,
আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে আজো চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?

সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে নাকি জামের নিবিড় ঘন ডালে,
মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে –
কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে
মধুর চাকের নিচে — মাছিগুলো উড়ে যায়… ঝ’রে পড়ে… ম’রে থাকে ঘাসে –
--------------------------------------------------
আবার আসিব ফিরে

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা রায় — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে –


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

Friday, February 19, 2010

শেষের কবিতা


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শেষের কবিতা – অধ্যায় ০১

অমিত- চরিত

অমিত রায় ব্যারিষ্টার। ইংরেজি ছাঁদে রায় পদবী “রয়” ও “রে” রূপান-র যখন ধারণ করলে তখন তার শ্রী গেল ঘুচে কিন’ সংখ্যা হল বৃদ্ধি। এই কারণে, নামের অসামন্যতা কামনা করে অমিত এমন একটি বানান বানালে যাতে ইংরেজ বন্ধু ও বন্ধুনীদের মুখে তার উচ্চারণ দাঁড়িয়ে গেল-অমিট রায়ে।
অমিতর বাপ ছিলেন দিগ্‌বিজয়ী ব্যারিষ্টার। যে পরিমাণ টাকা তিনি জমিয়ে গেছেন সেটা অধনস্ত তিন পুরুষকে অধঃপাতে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন’ পৈতৃক সম্পত্তির সাংঘাতিক সংঘাতেও অমিত বিনা বিপত্তিতে এ যাত্রা টিকে গেল।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ’র কোঠায় পা দেবার পূর্বেই অমিত অক্সফোর্ডে ভর্তি হয়; যেখানে পরীক্ষা দিতে দিতে এবং না দিতে দিতে ওর সাত বছর গেল কেটে। বুদ্ধি বেশি থাকাতে পড়াশুনো বেশি করে নি, অথচ বিদ্যেতে কমতি আছে বলে ঠাহর হয় না। ওর বাপ ওর কাছ থেকে অসাধারণ কিছু প্রত্যাশা করেন নি। তাঁর ইচ্ছে ছিল, তাঁর একমাত্র ছেলের মনে অক্স্‌ফোর্ডের রঙ এমন পাকা করে ধরে যাতে দেশে এসেও ধোপ সয়।
অমিতকে আমি পছন্দ করি। খাসা ছেলে। আমি নবীন লেখক, সংখ্যায় আমার পাঠক স্বল্প, যোগ্যতায় তাদের সকলের সেরা অমিত। আমার লেখার ঠাট-ঠমকটা ওর চোখে খুব লেগেছে। ওর বিশ্বাস, আমাদের দেশের সাহিত্যবাজারে যাদের নাম আছে তাদের স্টাইল নেই। জীবসৃষ্টিতে উট জনত্তটা যেমন, এই লেখকদের রচনাও তেমনি ঘাড়ে-গর্দানে সামনে-পিছনে পিঠে-পেটে বেখাপ, চালটা ঢিলে নড়বড়ে, বাংলা-সাহিত্যের মতো ন্যাড়া ফ্যাকাশে মরুভূমিতেই তার চলন। সমালোচকদের কাছে সময় থাকতে বলে রাখা ভালো, মতটা আমার নয়।
অমিত বলে, ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী। ওর মতে যারা সাহিত্যের ওমরাও দলের, যারা নিজের মন রেখে চলে, স্টাইল তাদেরই। আর যারা আমলা-দলের, দশেল মন রাখা যাদের ব্যবসা, ফ্যাশান তাদেরই। বঙ্কিমি স্টাইল লেখা “বিষবৃক্ষে” বঙ্কিম তাতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন; বঙ্কিমি ফ্যাশান নসিরামের লেখা ‘‘মনোমোহনের মোহনবাগানে”, নসিরাম তাতে বঙ্কিমকে দিয়েছে মাটি করে। বারোয়ারি তাঁবুর কানাতের নীচে ব্যাবসাদার নাচওয়ালির দর্শন মেলে, কিন’ শুভদৃষ্টিকালে বধূর মুখ দেখবার বেলার বেনারসি ওড়নার ঘোমটা চাই। কাতান হল ফ্যাশানের, আর বেনারসি হল স্টাইলের, বিশেষের মুখ বিশেষ রঙের ছায়ায় দেখবার জন্যে। অমিত বলে, হাটের লোকের পায়ে-চলা রাস্তার বাইরে আমাদের পা সরতে ভরসা পায় না বলেই আমাদের দেশে স্টাইলের এত অনাদর। দক্ষযজ্ঞের গল্পে এই কথাটির পৌরাণিক ব্যাখ্যা মেলে। ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ একেবারে স্বর্গের ফ্যাশানদুরস- দেবতা, যাজ্ঞিকমহলে তাঁদের নিমন্ত্রনও জুটত। শিবের ছিল স্টাইল, এত ওরিজিন্যাল যে, মন্ত্রপড়া যজমানেরা তাঁকে হব্যকব্য দেওয়াটা বেদস-র বলে জানত। অক্সফোর্ডের বি এ’র এ-সব কথা শুনতে আমার ভালো লাগে। কেননা, আমার বিশ্বাস, আমার লেখার ষ্টাইল আছে– সেইজন্যেই আমার সকল বইয়েরই এক সংস্করণেই কৈবল্যপ্রাপ্তি, তারা “ন পুনরাবর্তনে-”।
আমার শ্যালক নবকৃষ্ণ অমিতর এ-সব কথা একেবারে সইতে পারত না- বলত, “রেখে দাও তোমার অক্সফোর্ডের পাস।” সে ছিল ইংরেজি সাহিত্যে রোমহর্ষক এম,এ ; তাকে পড়তে হয়েছে বিস-র, বুঝতে হয়েছে অল্প। সেদিন সে আমাকে বললে, অমিত কেবলই ছোটো লেখককে বড়ো করে বড়ো লেখককে খাটো করবার জন্যেই। অবজ্ঞার ঢাক পিটোবার কাজে তার শখ, তোমাকে সে করেছে তার ঢাকের কাঠি।” দুঃখের বিষয়, এই আলোচনাস’লে উপসি’ত ছিলেন আমার স্ত্রী, স্বয়ং ওর সহোদরা। কিন্তু পরম সন্তোষের বিষয় এই যে, আমার শ্যালকের কথা তাঁর একটুও ভালো লাগে নি। দেখলুম, অমিতর সঙ্গেই তাঁর রুচির মিল, অথচ পড়াশুনো বেশি করেন নি। স্ত্রীলোকের আশ্চর্য স্বাভাবিক বুদ্ধি।
অনেক সময় আমার মনেও খটকা লাগে যখন দেখি, কত কত নামজাদা ইংরেজ লেখকদেকেও নগণ্য করতে অমিতর বুক দমে না। তারা হল, যাদের বলা যেতে পারে বহুবাজারে চলতি লেখক, বড়োবাজারের ছাপ-মারা; প্রশংসা করবার জন্যে যাদের লেখা পড়ে দেখবার দরকারই হয় না, চোখ বুজে গুণগান করলেই পাসমার্ক পাওয়া যায়। অমিতর পক্ষেও এদের লেখা পড়ে দেখা অনাবশ্যক, চোখ বুজে নিন্দে করতে ওর বাধে না। আসলে যারা নামজাদা তারা ওর কাছে বড়ো বেশি সরকারি বর্ধমানের ওয়েটিংরুমের মতো; আর যাদেরকে ও নিজে আবিষ্কার করেছে তাদের উপর ওর খাসদখল, যেন স্পেশাল ট্রেনের সেলুন কামরা।
অমিতর নেশাই হল স্টাইলে। কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে নয়, বেশে ভূষার ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদে আছে। পাঁচজনে মধ্যে ও যে-কোনো একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম। অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে। দাড়িগোঁফ- কামানো চাঁচা মাজা চিকন শ্যামবর্ন পরিপুষ্ট মুখ, স্ফূর্তি ভরা ভাবটা, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি হয় না; মনটা এমন এক রকমের চকমকি যে, ঠুন করে একটু ঠুকলেই স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ে। দেশী কাপড় প্রায়ই পরে, কেননা ওর দলের লোক সেটা পরে না। ধুতি সাদা থানের যত্নে কোঁচানো, কেননা ওর বয়সে এরকম ধুতি চলতি নয়। পাঞ্জাবি পরে, তরে বাঁ কাঁধ থেকে বোতাম ডানে দিকের কোমর অবধি, আসি-নের সামনের দিকটা কনুই পর্যন- দু-ভাগ করা; কোমরে ধুতিটাকে ঘিরে একটা জরি-দেওয়া চওড়া খয়েরি রঙের ফিতে, তারাই বাঁ দিকে ঝুলছে বৃন্দাবনী ছিটের এক ছোটা থলি, তার মধ্যে ওর ট্যাঁকঘড়ি, পায়ে সাদা চামড়ার উপর লাল চামড়ার কাজ-করা কটকি জুতো। বাইরে যখন যায় একটা পাট-করা পাড়ওয়ালা মাদ্রাজি চাদর বাঁ কাঁধ থেকে হাঁটু অবধি ঝুলতে থাকে; বন্ধুমহলে যখন নিমন্ত্রন থাকে মাথায় চড়ায় এক মুসলমানি লক্ষ্মেী টুপি, সাদার উপর সাদা কাজ-করা। একে ঠিক সাজ বলব না, এ হচ্ছে ওর এক রকমের উচ্চ হাসি। ওর বিলিতি সাজের মর্ম আমি বুঝি নে, যারা বোঝে তারা বলে– কিছু আলুথালু গোছের বটে, কিন’ ইংরেজিতে যাকে বলে ডিস্‌টিঙ্গুইশ্‌ড্‌। নিজেকে অপরূপ করবার শখ ওর নেই। কিন’ ফ্যাশানকে বিদ্রূপ করবার কৌতুক ওর অপর্যাপ্ত। কোনামতে বয়স মিলিয়ে যারা কুষ্ঠির প্রমাণে যুবক তাদের দর্শন মেলে পথে ঘাটে; অমিতর দুর্লভ যুবকত্ব নির্জলা যৌবনের জোরেই, একেবারে বেহিসেবি, উড়নচন্ডী, বান ডেকে ছুটে চলেছে বাইরের দিকে, সমস- নিয়ে চলেছে ভাসিয়ে, হাতে কিছুই রাখে না।
এ দিকে ওর দুই বোন, যাদের ডাকনাম সিসি এবং লিসি, যেন নতুন বাজারে অত্যন- হালের আমদানি– ফ্যাশানের পসরায় আপাদমস-ক যত্নে মোড়ক করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট-বিশেষ। উচুঁ খুরওয়ালা জুতো, লেসওয়ালা বুক-কাটা জ্যাকেটের ফাঁকে অ্যাম্বারে মেশানো মালা, শাড়িটা গায়ে তির্যগ্‌ভঙ্গিতে আঁট করে ল্যাপ্‌টানো। এরা খুট খুট করে দ্রুত লয়ে চলে; উচ্চেৎ স্বরে বলে; স-রে স-রে তোলে সূক্ষাগ্র হাসি; মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উঁচু কটাক্ষে চায়, জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি; গোলাপি রেশমের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুর ফুর করে সঞ্চালন করে, এবং পুরুষন্ধুর চৌকির হাতার উপরে বসে সেই পাখার আঘাতে তারে কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন প্রকাশ করে থাকে।
আপন দলের মেয়েদের সঙ্গে অমিতর ব্যবহার দেখে তার দলের পুরুষদের মনে ঈর্ষার উদয় হয়। নির্বিশেষে ভাবে মেয়েদের প্রতি অমিতর ঔদাসীন নেই, বিশেষ ভাবে কারো প্রতি আসক্তিও দেখা যায় সম্বন্ধে ওর আগ্রহ নেই, উৎসাহ আছে। অমিত পার্টিতেও যায়, তাসও খেলে, ইচ্ছে করেই বাজিতে হারে, যে রমনীর গলা বেসুরা তাকে দ্বিতীয়বার গাইতে পীড়াপীড়ি করে, কাউকে বদ-রঙের কাপড় পরতে দেখলে জিজ্ঞাসা করে কাপড়টা কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। যে-কোনো আলাপিতার সঙ্গেই কথা ব‘লে বিশেষ পক্ষপাতের সুর লাগায়; অথচ সবাই জানে, পক্ষপাতটা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। যে মানুষ অনেক দেবতার পূজারি, আড়ালে সব দেবতাকেই সে সব দেবতার চেয়ে বড়ো বলে স-ব করে; দেবতাদের বুঝতে বাকি থাকে না, অথচ খুশিও হন। কন্যার মাতাদের আশা কিছুতেই কমে না, কিন’ কন্যারা বুঝে নিয়েছে, অমিত সোনার রঙের দিগন-রেখা, ধরা দিয়েই আছে তবু কিছুতেই ধরা দেবে না। মেয়েদের সম্বন্ধে ওর মন তর্কই করে, মীমাংসা আসে না। সেইজন্যেই গম্যবিহীন আলাপের পথে ওর এত দুঃসাহস। তাই অতি সহজেই সকলের সঙ্গে ও ভাব করতে পারে, নিকটে দাহ্যবস’ থাকলেও ওর তরফে আগ্নেয়তা নিরাপদে সুরক্ষিত।
সেদিন পিকনিকে গঙ্গার ধারে যখন ও পারের ঘন কালো পুঞ্জীভূত স-ব্ধতার উপরে চাঁদ উঠল, ওর পাশে ছিল লিলি গাঙ্গুলি। তাকে ও মৃদুস-রে বললে, “গঙ্গার ও পারে ঐ নতুন চাঁদ, আর এ পারে তুমি আর আমি, এমন সমাবেশটি অনন-কালের মধ্যে কোনাদিনই আর হবে না”।
প্রথমটা লিলি গাঙ্গুলির মন এক মুহূর্তে ছল্‌ছলিয়ে উঠেছিল; কিন’ সে জানত, এ কথাটায় যতখানি সত্য সে কেবল ঐ বলার কায়দাটুকুর মধ্যেই। তার বেশি দাবি করতে গেলে বুদবুদের উপরকার বর্নচ্ছটাকে দাবি করা হয়। তাই নিজেকে ক্ষণকালের ঘোর-লাগা থেকে ঠেলা দিয়ে লিলি হেসে উঠল, বললে, “অমিট, তুমি যা বললে সেটা এত বেশি সত্য যে, না বললেও চলত। এই মাত্র যে ব্যাঙটা টপ করে জলে লাফিয়ে পড়ল এটাও তো অনন-কালের মধ্যে আর কোনাদিন ঘটবে না”।
অমিত হেসে উঠে বললে, “তফাত আছে, একেবারে অসীম তফাত। আজকের সন্ধ্যাবেলায় ঐ ব্যাঙের লাফানোটা একটা খাপছাড়া ছেঁড়া জিনিস। কিন’ তোমাতে আমাতে চাঁদেতে, গঙ্গার ধারায়, আকাশের তারায়, একটা সম্পূর্ণ ঐকতানিক সৃষ্টি–বেটোফেনের চন্দ্রালোক-গীতিকা। আমার মনে হয় যেন বিশ্বকর্মার কারখানায় একটা পাগলা স্বর্গীয় স্যাকরা আছে; সে যেমনি একটি নিখুঁত সুগোল সোনার চক্রে নীলার সঙ্গে হীরে এবং হীরের সঙ্গে পান্না লাগিয়ে এক প্রহরের আঙটি সম্পূর্ণ করলে আমনি দিলে সেটা সমুদ্রের জলে ফেলে, আর তাকে খুঁজে পাবে না কেউ”।
“ভালোই হল, তোমার ভাবনা রইল না, অমিট, বিশ্বকর্মার স্যাকরার বিল তোমাকে শুধতে হবে না”।
“কিন’ লিল, কোটি কোটি যুগের পর যদি দৈবাৎ তোমাতে আমাতে মঙ্গলগ্রহের লাল অরন্যের ছায়ায় তার কোনো-একটা হাজার-ক্রোশী খালের ধারে মুখোমুখি দেকা হয়, আর যদি শকুন-লার সেই জেলেটা বোয়াল মাছের পেট চিরে আজকের এই অপরূপ সোনার মূহূর্তটিকে আমাদের সামনে এনে ধরে, চমকে উঠে মুখ-চাওয়া-চাউয়ি করব, তার পরে কী হবে ভেবে দেখো”।
লিলি অমিতকে পাখার বাড়ি তাড়না করে বললে, “তার পরে সোনার মুহূর্তটি অন্যমনে খসে পড়বে সমুদ্রের জলে। আর তাকে পাওয়া যাবে না। পাগলা স্যাকরার গড়া এমন তোমার কত মূহুূর্ত খসে পড়ে গেছে, ভুলে গেছ বলে তার হিসেব নেই”।
এই বলে লিলি তাড়াতাড়ি উঠে তার সখীদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিলে। অনেক ঘটনার মধ্যে এই একটা ঘটনার নমুনা দেওয়া গেল।

অমিতর বোন সিসি-লিসিরা ওকে বলে, “আমি তুমি বিয়ে কর না কেন?”
অমিত বলে, “বিয়ে ব্যাপারটায় সকলের চেয়ে জরুরি হচ্ছে পাত্রী, তার নীচেই পাত্র”।
সিসি বলে, “অবাক করলে, মেয়ে এত আছে”।
অমিত বলে, “মেয়ে বিয়ে করত সেই পুরাকালে লক্ষণ মিলিয়ে। আমি চাই পাত্রী আপন পরিচয়েই যার পরিচয়, জগতে যে অদ্বিতীয়।”
সি সি বলে, “তোমার ঘরে এলেই তুমি হবে প্রথম, সে হবে দ্বিতীয়, তোমার পরিচয়েই হবে তার পরিচয়”।
অমিত বলে, “আমি মনে মনে যে মেয়ের ব্যর্থ প্রত্যাশায় ঘটকালি করি সে গরঠিকানা মেয়ে। প্রায়ই সে ঘর পর্যন- এসে পৌঁছয় না। সে আকাশ থেকে পড়ন- তারা, হৃদয়ের বায়ুমন্ডল ছুঁতে-না-ছুঁতেই জ্বলে ওঠে, বাতাসে যায় মিলিয়ে, বাস’ঘরের মাটি পর্যন- আসা ঘটেই ওঠে না।”
সিসি বলে, “অর্থাৎ সে তোমার বোনেদের মতো একটুও না”।
অমিত বলে, “অর্থাৎ, সে ঘরে এসে কেবল ঘরের লোকেরই সংখ্যা বৃদ্ধি করে না।”
লিসি বলে, “আচ্ছা ভাই সিসি, বিমি বোস তো অমির জন্যে পথ চেয়ে তাকিয়ে আছে, ইশারা করলেই ছুটে এসে পড়ে, তাকে ওর পছন্দ নয় কেন? বলে, তার কালচার নেই। কেন ভাই, সে তো এম,এ-তে বটানিতে ফারস্ট্‌। বিদ্যেকেই তো বলে কালচার।”
অমিত বলে, “কমল-হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি।”
লিসি রেগে উঠে বলে, “ইস, বিমি বোসের আদর নেই ওর কাছে! উনি নিজেই নাকি তার যোগ্য! অমি যদি বিমি বোসকে বিয়ে করতে পাগল হয়েও ওঠে আমি তাকে সাবধান করে দেব, সে যেন ওর দিকে ফিরেও না তাকায়।”
অমিত বললে, “পাগল না হলে বিমি বোসকে বিয়ে করতে চাইবই বা কেন? সে সময়ে আমার বিয়ের কথা না ভেবে উপযু্‌ক্ত চিকিৎসার কথা ভেবো।”
আত্নীয়স্বজন অমিতর বিয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছে। তারা ঠিক করেছে, বিয়ের দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা ওর নেই, তাই ও কেবল অসম্ববের স্বপ্ন দেখে আর উলটো কথা বলে মানুষকে চমক লাগিয়ে বেড়ায়। ওর মনটা আলেয়ার আলো, মাঠে বাটে ধাঁধা লাগাতেই আছে, ঘরের মধ্যে তাকে ধরে আনবার জো নেই।
ইতিমধ্যে অমিত যেখানে সেখানে হো হো করে বেড়াচ্ছে- ফিরপোর দোকানে যাক তাকে চা খাওয়াচ্ছে; যখন তখন মোটরে চড়িয়ে বন্ধুদের অনাবশ্যক ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে; এখান ওখান থেকে যা তা কিনছে আর একে ওকে বিলিয়ে দিচ্ছে; ইংরেজি বই সদ্য কিনে এ বাড়িতে ও বাড়িতে ফেলে আসছে, আর ফিরিয়ে আনছে না।
ওর বোনেরা ওর যে অভ্যাসটা নিয়ে ভারি বিরক্ত সে হচ্ছে ওর উলটো কথা বলা। সজ্জনসভায় যা-কিছু সর্বজনের অনুমোদিত ও তার বিপরীত কিছু-একটা বলে বসবেই।
একদা কোন-একজন রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ডিমোক্রাসির গুণ বর্ণনা করছিল; ও বলে উঠল, ‘বিষ্ণু যখন সতীর মৃতদের খন্ড খন্ড করলেন তখন দেশ জুড়ে যেখানে সেখানে তাঁর একশোর অধিক পীঠস্থান তৈরি হয়ে গেল। ডিমোক্রসি আজ যেখানে সেখানে যত টুকরো অ্যারিস্টক্রেসির পুজো বসিয়েছে- খুদে খুদে অ্যারিষ্টক্রাটে পৃথিবী ছেয়ে গেল, কেউ পলিটিক্সে, কেউ সাহিত্যে, কেউ সমাজে। তাদের কারো গাম্ভীর্য নেই, কেননা তাদের নিজের পরে বিম্বাস নেই।’
একদা মেয়েদের পরে পুরুষের আধিপত্যের অত্যাচার নিয়ে কোনো সমাজহিতৈষী অবলাবান্ধব নিন্দা করছিল পুরুষদের। অমিত মুখ থেকে সিগারেটা নামিয়ে ফস্‌ করে বললে, পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করবে। দুর্বলের আধিপত্য অতি ভয়ংকর।’
সভাস’ অবলা ও অন্বান্ধবেরা চটে উঠে বললে, ‘মানে কী হল’? করতে আসবে, তাই করতে গিয়েই তার হবে মরণ। তার পরে কিছুদিন যেতেই কিস্কিন্ধ্যা জেগে উঠবে, কোন হনুমান হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে মনটাকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসবার ব্যবসা করবে। তখন আবার হবে টেনিসনের সঙ্গে পুনর্মিলন, বায়রনের গলা জড়িয়ে করব অশ্রুবর্ষণ, ডিকেনসকে বলব, মাপ করো, মোহ থেকে আরোগ্যলাভের জন্যে তোমাকে গাল দিয়েছি।…. মোগল বাদশাদের কাল থেকে আজ পর্যন- দেশের যত মুগ্ধ মিস্ত্রি মিলে যদি যেখানে সেখানে ভারত জুড়ে কেবলই গম্বুজওয়ালা পাথরের বুদ্‌বুদ্‌ বানিয়ে চলত তা হলে ভদ্রলোক মাত্রই যেদিন বিশ বছর বয়স পেরোত সেইদিনই বানপ্রস’ নিতে দেরি করত না। তাজমহলকে ভালো লাগাবার জন্যেই তাজমহালে নেশা ছুটিয়ে দেওয়া দরকার।
(এইখানে বলে রাখা দরকার, কথার তোড় সামলাতে না পেরে সভার রিপোর্টারের মাথা ঘুরে গিয়েছিল, সে যা রিপোর্ট লিখেছিল সেটা অমিতর বক্তৃতার চেয়েও অবোধ্য হয়ে উঠেছিল। তারই থেকে য-কটা টুকবো উদ্ধার করতে পারলম তাই আমার উপরে সাজিয়ে দিয়েছি।।
তাজমহলের পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গে রবি ঠাকুরের ভক্ত আরক্ত-মুখে বলে উঠল, ভালো জিনিস যত বেশি হয় ততই ভালো’।
অমিত বললে, ‘ঠিক তার উল্টো। বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।… যে সব কবি ষা্‌ট-ষত্তর পর্যন- বাঁচতে একটুও লজ্জা করে না তারা নিজেকে শাসি- দেয় নিজেকে সস্তা করে দিয়ে। শেষকালটায় অনুকরণের দল চারি দিকে ব্যুহ বেঁধে তাদেরকে মুখ ভেঙচাতে থাকে। তাদের লেখার চরিত্র বিগড়ে যায়, পূর্বের লেখা থেকে চুরি শুরু করে হয়ে পড়ে পূর্বের লেখার রিসিভর্‌স্‌ অফ স্টোল্‌ন্‌ প্রপার্টি। সে স’লে লোকহিতের খাতিরে পাঠকদের কর্তব্য হচ্ছে, কিছুতেই এই-সব অতিপ্রবীণ কবিদের বাঁচতে না দেওয়া, শারীরিক বাঁচার কথা বলছি নে, কাব্যিক বাঁচা। এদের পরমায়ু নিয়ে বেঁচে থাক্‌ প্রবীণ অধ্যাপক, প্রবীণ পোলিটিশন, প্রবীণ সমালোচক।’
সেদিনকার বক্তা বলে উঠল, ‘জানতে পারি কি, কাকে আপনি প্রেসিডেন্ট করতে চান? তার নাম করুন।’
অমিত ফস্‌ করে বললে, ‘ নিরাবণ চক্রবর্তী’।
সভার নানা চৌকি থেকে বিস্মিত রব উঠল, ‘নিবারণ চক্রবর্তী! সে লোকটা কে?’
‘আজকের দিনে এই-যে প্রশ্নের অঙ্কুর মাত্র, আগামী দিনে এর থেকে উত্তরের বনস্পতি জেগে উঠবে।’
‘ইতিমধ্যে আমরা একটা নমুনা চাই’।
‘তবে শুনুন’।

ব’লে পকেট থেকে একটা সরু লম্বা ক্যাম্বিসে -বাধা খাতা বের করে তার থেকে পড়ে গেল-

আনিলাম
অপরিচিতের নাম
ধরনীতে,
পরিচিত জনতার সরনীতে।
আমি আগনত্তক,
আমি জনগণেশের প্রচন্ড কৌতুক।
খোলো দ্বার,
বার্তা আনিয়াছি বিধাতার।
মহাকালেম্বর

অমিত বললে, ‘যে পক্ষের দখলে শিকল দিয়েই পাখিকে বাঁধে, অর্থাৎ জোর দিয়ে। শিকল নেই যার সে বাঁধে আফিম খাইয়ে, অর্থাৎ মায়া দিয়ে। শিকলওয়ালা বাঁধা বটে কিন’ ভোলায় না, আফিমওয়ালী বাঁধেও বটে ভোলায়ও। মেয়েদের কৌটো আফিমে ভরা, প্রকৃতি-শয়তানী তার জোগান দেয়।’
একদিন এওদর বালিগঞ্চের এক সাহিত্যসভায় রবি ঠাকুরের কবিতা ছিল আলোচনার বিষয়। অমিতরা জীবনে এই সে প্রথম সভাপতি হতে রাজি হয়েছিল; গিয়েছিল মনে মনে যুদ্ধসাজ পরে। একজন সেকেলে গোছের অতি ভালোমানুষ ছিল বক্তা। রবি ঠাকুরের কবিতা যে কবিতাই এইটে প্রমাণ করাই তার উদ্দেশ্য। দুই-একজন কলেজের অধ্যাপক ছাড়া অধিকাংশ সভ্যই স্বীকার করলে, প্রমাণটা একরকম সনে-াষজনক।
সভাপতি উঠে বললে, ‘কবিমাত্রের উচিত পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন-। এ কথা বলব না যে পরবর্তীদের কাছ থেকে আরো ভালো কিছু চাই, বলব অন্য কিছু চাই। ফজলি আম ফুরালে বলব না, আনো ফজরিতর আম; বলব, নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে। ডাব-নারকেলের মেয়াদ অল্প, সে রসের মেয়াদ; ঝুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি; সে শাঁসের মেয়াদ। কবিরা হল ক্ষণজীবী, ফিলজফরের বয়সের গাছপাথর নেই।… রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো নালিশ এই যে,বুড়ো ওয়ার্ডস্বার্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়রকম বেঁচে আছে। যম বাতি নিবিয়ে দেবার জন্যে থেকে থেকে ফরাশ পাঠায়, তবু লোকটা দাাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চৌকির হাতা আঁকড়িয়ে থাকে। ও যদি মানে মানে নিজেই সরে না পড়ে, আমাদের কর্তব্য ওর সভা ছেড়ে দল বেঁধে উঠে আসা। পরবর্তী যিনি আসবেন তিনিও তাল ঠুকেই গর্জাতে গর্জাতে আসবেন যে, তাঁর রাজত্বের অবসান নেই, অমরা বর্তী বাঁধা থাকবে মর্তে তাঁরই দরজায়। কিছুকাল ভক্তরা দেবে মাল্যচন্দন, খাওয়াবে পেট ভরিয়ে, সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করবে, তার পরে আসবে তাঁকে বলি দেবার পুন্যদিন-ভক্তিবন্ধন থেকে ভক্তদের পরিত্রাণের শুভলগ্ন। আফ্রিকার চতুষ্পদ দেবতার পুজোর প্রনালী এই রকমই। দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদী চতুর্দশপদী দেবতাদের পুজোও এই নিয়মে। পূজা জিনিসটাকে একঘেয়ে করে তোলার মতো অপবিত্র অধার্মিকতা আর- কিছু হতে পারে না। … ভালো-লাগার এভোল্যুশন আছে। পাঁচ বছর পূর্বেকার ভালো-লাগা পাঁচ বছর পরেও যদি এই জায়গায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে, বেচারা জানতে পারে নি যে সে মরে গেছে। একটু ঠেলা মারলেই তার নিজের কাছে প্রমাণ হবে যে, সেন্টিমেন্টাল আত্মীয়েরা তার অনে-্যষ্টি- সৎকার করতে বিলম্ব করেছিল, বোধ করি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে চিরকাল ফাঁকি দেবার মতলবে। রবি ঠাকুরের দলের এই অবৈধ ষড়যন্ত্র আমি পাবলিকের কাছে প্রকাশ করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছি।’
আমাদের মণিভূষণ চশমার ঝলক লাগিয়ে প্রশ্ন করলে, ‘সাহিত্যে থেকে লয়ালটি উঠিয়ে দিতে চান?’
‘একেবারেই। এখন থেকে কবি প্রেসিডেন্টের দ্রুত-নিঃশেষিত যুগ। রবি ঠাকুর সম্বন্ধে আমার দ্বিতীয় বক্তব্য এই যে, তাঁর রচনারেখা তাঁরই হাতের অক্ষরের মতো-গোল বা তরঙ্গরেখা, গোলাপ বা নারীর মুখ বা চাঁদের ধরনে। ওটা প্রিমিটিভ; প্রকৃতির হাতের অক্ষরের মক্‌শো-করা। নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে চাই কড়া লাইনের, খাড়া লাইনের রচনা-তীরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো; ফুলের মতো নয়; বিদ্যুতের রেখার মতো, ন্যুরাল্‌জিয়ার ব্যথার মতো- খোঁচাওয়ালা, কোণওয়ালা, গথিক গির্জের ছাঁদে; মন্দিরের মন্ডপের ছাঁদে নয়; এমন কি, যদি চটকল পাটকল অথবা সেক্রেটারিয়েট- বিল্‌ডিঙের আদলে হয়, ক্ষতি নেই।… এখন থেকে ফেলে দাও মন ভোলাবার ছলাকলা ছন্দোবন্ধ, মন কেড়ে নিতে হবে যেমন রাবন সীতাকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। মন যদি কাঁদতে কাঁদতে আপত্তি করতে করতে যায় তবুও তাকে যেতেই হবে- অতিবৃদ্ধ জটায়ুটা বারণ

পাঠায়েছে দুর্লক্ষ্য অক্ষর,
বল্‌ দুৎসাহসী কে কে
মৃত্যু পণ রেখে
দিবি তার দুরূহ উত্তর।
শুনিবে না।
মুঢ়তার সেনা
করে পথরোধ।
ব্যর্ত ক্রোধ
হুংকারিয়া পড়ে বুকে-
তরঙ্গের নিষ্ফলতা
নিত্য যথা
মরে মাথা ঠুকে
শৈলতট-পরে
আত্মঘাতী দম্ভভরে।
পুষ্পমাল্য নাহি মোর, রিক্ত বক্ষতল,
নাহি বর্ম অঙ্গদ কুন্ডল।
শূন্য এ ললাটপটে লিখা
গুঢ় জয়টিকা।
ছিন্নকস’া দরিদ্রের বেশ।
করিব নিঃশেষ
তোমার ভান্ডার।
খোলা খোলা দ্বার।
অকস্মাৎ
বাড়ায়েছি হাত,
যা দিবার দাও অচিরাৎ!
বক্ষ তব কেঁপে ওঠে, কম্পিত অর্গল,
পৃথ্বী টলমল।
ভয়ে আর্ত উঠিছে চীৎকারি
দিগন- বিদারি-
‘ফিরে যা এখনি,
রে দুর্দান- দুরন- ভিখারি,
তোর কন্ঠধ্বনি
ঘুরি ঘুরি
নিশীথনিদ্রার বক্ষে হানে তীব্র ছুরি।’
অস্ত্র আনো।
ঝঞ্চ্র নিয়া আমার পঞ্জরে হানো।
মৃত্যুরে মারুক মৃত্যু, অক্ষয় এ প্রাণ
করি যাব দান।
শৃঙ্খল জড়াও তবে,
বাঁধো মোরে, খন্ড খন্ড হবে
মুহূর্তে চকিতে-
মুক্তি তব আমারি মুক্তিতে।
শাস্ত্র আনো।
হানো মোরে, হানো।
পন্ডিতে পন্ডিতে
ঊর্ধ্ব স্বরে চাহিবে খন্ডিতে
দিব্য বানী।
জানি জানি,
তর্কবাণ
হয়ে যাবে খান-খান।
মুক্ত হবে জীর্ণ বাক্যে আচ্ছন্ন দু চোখ,
হেরিবে আলোক।
অগ্নি জ্বালো।
আজিকার যাহা ভালো
কল্য যদি হয় তাহা কালো,
যদি তাহা ভস্ম হয়
বিশ্বময়,
ভস্ম হোক।
দুর করো শোক।
মোর অগ্নিপরীক্ষায়
ধন্য হোক বিশ্বলোক অপূর্ব দীক্ষায়।
আমার দুর্বোধ বানী
বিরুদ্ধ বুদ্ধির পরে মুষ্টি হানি
করিবে তাহারে উচ্চকিত,
আতঙ্কিত।
উন্মাদ আমার ছন্দ
দিবে ধন্দ
শানি-লুব্ধ মুমুক্ষুরে,
ভিক্ষাজীর্ণ বুভুক্ষুরে।
শিরে হস- হেনে
একে একে নিবে মেনে
ক্রোধে ক্ষোভ ভয়ে
লোকালয়ে
অপরিচিতের জয়,
অপরিচিতের পরিচয়-
যে অপরিচিত
বৈশাখের রুদ্র ঝড়ে বসুন্ধরা করে আন্দোলিত,
হানি বজ্রমুঠি
মেঘের কার্পন্য টুটি
সংগোপন বর্ষনসঞ্চয়
ছিন্ন করে, মুক্ত করে সর্বজগন্ময়।।

রবি ঠাকুরের দল সেদিন চুপ করে গেল। শাসিয়ে গেল, লিখে জবাব দেবে।
সভাটাকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে মোটরে করে অমিত যখন বাড়ি আসছিল সিসি তাকে বললে,‘একখানা আন- নিবারণ চক্রবর্তী তুমি নিশ্চয় আগে থাকতে গড়ে তুলে পকেটে করে নিয়ে এসেছ, কেবলমাত্র ভালোমানুষদের বোকা বানাবার জন্যে।’
অমিত বললে, ‘অনাগতকে যে মানুষ এগিয়ে নিয়ে আসে তাকেই বলে অনাগতবিধাতা। আমি তাই। নিবারণ চক্রবর্তী আজ মর্তে এসে পড়ল, কেউ তাকে আর ঠেকাতে পারবে না।’
সিসি অমিতকে নিয়ে মনে মনে খুব একটা গর্ব বোধ করে।
সে বললে, ‘আচ্ছা অমিত, তুমি কি সকালবেলা উঠেই সেদিনকার মতো তোমার যত শানিয়ে- বলা কথা বানিয়ে রেখে যাও?’
অমিত বললে, সম্ববপরের জন্যে সব সময়ে প্রসত্তত থাকাই সভ্যতা; বর্বরতা পৃথিবীতে সকল বিষয়েই অপ্রসত্তত। এ কথাটাও আমার নোটবইয়ে লেখা আছে।’
‘কিন’ তোমার নিজের মত বলে কোনো পদার্থই নেই; যখন যেটা বেশ ভালো শোনায় সেইটেই তুমি বলে বস।’
‘আমার মনটা আয়না, নিজের বাঁধা মতগুলো নিয়েই চিরদিনের মতো যদি তাকে আগাগোড়া লেপে রেখে দিতুম তা হলে তার উপরে প্রত্যেক চলতি মূহূর্তের প্রতিবিম্ব পড়ত না।’
সিসি বললে,‘আমি, প্রতিবিম্ব নিয়েই তোমার জীবন কাটবে।’


sasar kobitha
sasar kobitha.pdf
Hosted by eSnips

আবৃতি

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

যদি ভালোবাসা পাই


রফিক আজাদ

যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেবো
জীবনের ভুলগুলি;
যদি ভালোবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘ পথে
তুলে নেবো ঝোলাঝুলি
যদি ভালোবাসা পাই শীতের রাতের শেষে
মখমল দিন পাবো
যদি ভালোবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো আর
সমুদ্র সাঁতরাবো
যদি ভালোবাসা পাই আমার আকাশ হবে
দ্রুত শরতের নীল
যদি ভালোবাসা পাই জীবনে আমিও পাবো
মধ্য অন্ত্য মিল।
যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেবো
জীবনের ভুলগুলি
যদি ভালোবাসা পাই শিল্প-দীর্ঘ পথে
বয়ে যাবো কাঁথাগুলি…


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

Monday, February 15, 2010

বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ


মহাদেব সাহা
আবৃত্তি রুদ্রাক্ষর


আমি হয়তো কোনোদিন কারো বুকে
জাগাতে পারিনি ভালোবাসা,
ঢালতে পারিনি কোনো বন্ধুত্বের
শিকড়ে একটু জল-
ফোটাতে পারিনি কারো একটিও আবেগের ফুল
আমি তাই অন্যের বন্ধুকে চিরদিন বন্ধু বলেছি;
আমার হয়তো কোনো প্রেমিকা ছিলো না,
বন্ধু ছিলো না,
ঘরবাড়ি, বংশপরিচয় কিচ্ছু ছিলো না,
আমি ভাসমান শ্যাওলা ছিলাম,
শুধু স্বপ্ন ছিলাম;
কারো প্রেমিকাকে গোপনে বুকের মধ্যে
এভাবে প্রেমিকা ভেবে,
কারো সুখকে এভাবে বুকের মধ্যে
নিজের অনন্ত সুখ ভেবে,
আমি আজো বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ।
তোমাদের সকলের উষ্ণ ভালোবাসা, তোমাদের
সকলের প্রেম
আমি সারি সারি চারাগাছের মতন আমার বুকে
রোপণ করেছি,
একাকী সেই প্রেমের শিকড়ে আমি
ঢেলেছি অজস্র জলধারা।
সকলের বুকের মধ্যেই একেকজন নারী আছে,
প্রেম আছে,
নিসর্গ-সৌন্দর্য আছে,
অশ্রুবিন্দু আছে
আমি সেই অশ্রু, প্রেম, ও নারী ও স্বপ্নের জন্যে
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগেছি;
সকলের বুকের মধ্যে যেসব শহরতলী আছে,
সমুদ্রবন্দর আছে
সাঁকো ও সুড়ঙ্গ আছে, ঘরবাড়ি
আছে
একেকটি প্রেমিকা আছে, প্রিয় বন্ধু আছে,
ভালোবাসার প্রিয় মুখ আছে
সকলের বুকের মধ্যে স্বপ্নের সমুদ্রপোত আছে,
অপার্থিব ডালপালা আছে।
আমি সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, সেই স্বপ্ন
সেই রূপকথার
জীবন্তমানুষ হয়ে আছি;
আমি সেই স্বপ্নকথা হয়ে আছি, তোমাদের
প্রেম হয়ে আছি,
তোমাদের স্বপ্নের মধ্যে ভালোবাসা হয়ে আছি
আমি হয়ে আছি সেই রূপকথার স্বপ্নমানুষ।


Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

Friday, February 12, 2010

খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়


লালন ফকির

খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।।
আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না-মহল তায়।।
কপালে মোর নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার
খাঁচা খুলে পাখী আমার
কোন বনে পালায়।।
মন, তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর তৈরী কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে
লালন কেঁদে কয়।।
লালন কয় খাঁচা খুলে
সে পাখী কোনখানে পালায়।।